সংবিধানে বলা আছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথক আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্য যতটা প্রদান করেন সেই অনুযায়ী কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা দেখিনি। বরং এর চেয়ে ঢের বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার নামে তার কণ্ঠ রোধ করার প্রচেষ্টায়।
দল নির্বিশেষে সব ক্ষমতাসীন সরকারই একাজটি সুক্ষভাবে সম্পন্ন করেছেন। তাদের বক্তব্য একটাই ‘বিচার বিভাগের জবাব দিহীতা নিশ্চিত করা’। কেউ জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নয়।
‘জবাবদিহিতা’ নিশ্চিত করার জন্য সংসদ ও দেশের বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাড় করানো করানো হয়েছে। বিচারকের মন্তব্য নিয়ে সংসদ উত্তপ্ত হয়েছে। কার্যপ্রণালী বিধির কোনো তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত মন্তব্য পর্যন্ত করা হয়েছে। বিচারকের পদচ্যূতির কথাও উঠেছে। মাননীয় স্পিকারকে তাঁর বিরুদ্ধে রুলিং পর্যন্ত দিতে হয়েছে। আবার সময়ের পরিক্রমায় সেই বিচারপতিকেই পদচ্যূতির বদলে পদোন্নতিও প্রদান করা হয়েছে। তাই ‘বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা’ একটি রাজনৈতিক বক্তব্য মাত্র। মূল প্রশ্নটি রাজনৈতিক। রাজনীতিবীদদের চোখ রাঙানো বরদাস্ত করা হবে না। কারণ এটি গণতান্ত্রিক দেশ।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে কম কথা হয়নি। রক্তারক্তিও কম হয়নি। অনেক সংলাপ আলোচনা করেও পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা যায়নি, বরং তার বাস্তবায়ন করা হয়েছে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন পরিচালনা করে।
দেশে সাংবিধানি ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই ছিলো সরকারের মূল বক্তব্য । কিন্তু ষষ্ঠদশ সংশোধনী করতে সরকার বিচার বিভাগের বদলে নিজেই সুয়োমটো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর সাংবিধানিক বিরোধীদল (জাপা) বা বিএনপি এবিষয়ে নিশ্চুপ। কারণ, আজ সরকার যা কিছু করবে আগামীতে তারা ক্ষমতায় আসলে তার সুফল ভোগ করবে।
দেশের বিচারকদের অপসারনের ক্ষমতা যদি সংসদের হাতেই না থাকে তবে গণতন্ত্রতো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা হলো না। তাই পূর্নাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংসদের হাতেই থাকতে হবে বিচারকদের অপসারনের ক্ষমতা। একেই বলে ‘সংসদের সার্বভৌমত্ব’। সেন বাবুদের কাছে সংসদের সার্বভৌমত্বের মানে এরকমই।
বিচারকদের চাকরি সংসদের হাতে আনার জন্য আইনের খসড়া প্রায় চুড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিও পাওয়া গেছে। তাই শুভকাজে আর দেরি নাই।
খসড়া আইনে বলা হচ্ছে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা যে কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে।
একটি রাষ্ট্রে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ তার নিজ এখতিয়ারের মধ্যে থেকে একে অপরের সহযোগি শক্তি হিসেবে কাজ করে। একটি আদর্শ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ হলো আইন ও গণতন্ত্রের রক্ষা কবচ। কিন্তু অন্যান্য সব শক্তিগুলো যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রে বিশ্বাস না করে তবে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে না।
কারণ, বিচার বিভাগের ওপর সংসদের কর্তৃত্ব দিলে তা হবে দেশের জন্য অশনিসংকেত। বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা আমাদের সংবিধানে একসময় ছিল (১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৯৬ ধারা)। সেই সময় আমরা পার করে এসেছি। তারপর সংবিধান বহুবার সংশোধন করা হয়েছে। কখনোই বিচারপতিদের চাকরি এমপিসাহেবদের হাতে আনার প্রয়োজন হয়নি। আজ কেন হলো?
যদিও পৃথিবীর বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে সংসদের হাতেই থাকে বিচারপতিদের চাকরি। কিন্তু আমাদের দেশে সেই বাস্তবতা নেই। আমাদের রাজনীতিও ভিন্নরুপ। তাই এ বিধান জারি করা মানে হলো বিচার বিভাগকে পুরোপুরি আইন বিভাগের অভিনস্ত করা। যেখানে ‘স্বাধীন বিচার বিভাগের’ ধারণা একটি রাজনৈতিক বক্তব্যমাত্র। আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘ন্যায়বিচার’ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই তখন রাজনীতিবীদদের হাতে ন্যাস্ত হবে আর বিচারপতিরা তখন কেবল চাকরিই করবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৪