স্যার! ২০৯৯ সনে আমরা এই প্রজন্মের কেউ থাকবোনা। সে সময়কার বাংলাদেশের রূপকল্পও মাথায় আসেনা।
এমনি করে আপনার লেখা মাসদার হোসেন (১৯৯৯) ‘কৌতূহলভরে’ পড়ুক সে জমানার বাংলাদেশের মানুষ। বিচারিক মাহাত্ম্য তখন স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠুক। একদিকে মারবারি-ম্যাডিসন-মার্শাল অন্যদিকে মাসদার হোসেন-মোস্তাফা কামাল!
আপনার সঙ্গে দেখা না হলেও মনে মনে অনেক সংলাপ করেছি আমি। বোধকরি সামনে বসে আপনার বক্তৃতাও শুনেছি। বাংলাদেশ কন্সটিটিউশন: ট্রেন্ডস এন্ড ইস্যুজ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৪)-তো আপনার ‘আলমা-মাত্তার’-এ দেয়া আপনার বক্তৃতাই, তাইনা স্যার? বইটি পড়লে মনে হয় ওই স্মারক বক্তৃতাটি আমি দর্শক সারিতে বসে শুনছি। ওটি বই হিসেবে না বেরুলে মাহমুদুল ইসলাম (সাংবিধানিক আইন, বিলিয়া, ১৯৯৬) পূর্বকালে আমাদের সংবিধানের উপর বলার মতন বই-ই যে আর থাকতনা!
আপনাকে একটি কথা বলি....এ আমার সত্যি কথা! ওই বইটি পড়ে কেন যেন মনে হয়েছিলো কোনো এক মাসদার হোসেনের জন্য আপনি সাগ্রহে অপেক্ষায় নয়, রীতিমতো প্রতীক্ষায় ছিলেন! তেল-জলের অলীক মিশ্রণের আটপৌরে উদাহরণ টেনে আপনি আমাদের বিচার বিভাগ-নির্বাহী বিভাগ গুলিয়ে ফেলার ‘সাংবিধানিক বিভ্রম’ ধরিয়ে দেন [অর্থ মন্ত্রণালয় বনাম মাসদার হোসেন (২০০০), ডিএলআর ৫২-তম কিস্তি, অনুচ্ছেদ ৪১ ও ৪৩]।
আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন করবার ছিলো, করা হলোনা। প্রশ্নটা হলো সংস্কৃতিমনা বিচারক অধিক মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন রায় লেখেন কিনা! আপনার বাবার সঙ্গীত-সৌন্দর্য কি কোনোভাবে আপনার মাটি-মানুষমূখী আইনচিন্তার খোরাকী হয়েছিল? মহিউদ্দন ফারুক [ডিএলআর ৪৯ কিস্তি, পাতা ১] পড়ে তাই মনে হয়। ‘মানুষ’-কে আপনি আইনের কেন্দ্রবিন্দু ধরে সেটিকে সেবার নিরিখে সংগীতায়ন (সাংগায়ন) করলেন বটে।
রিট কে করতে পারবে এমন শ্লোকে আপনি ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির’ ধারণায় মানুষের প্রতি দরদ ও সহানুভূতির বিষয়টি সামনে আনলেন। জনস্বার্থ মামলায় ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটিয়ে (কাজী মুখলেসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ, ডিএলআর ২৬ কিস্তি, ১৯৭৪, পাতা ৪৪) আমরা দীর্ঘকাল যে আকালে ছিলাম, তার বিচারিক বন্ধ্যাত্ব ঘুচালেন আপনি মহিউদ্দিন ফারুকে (১৯৯৬)।
মানুষের সৈকতে নিজেকে দাঁড় করিয়ে আপনি লিখলেন যে, আমাদের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ, মানবাধিকার ও মৌলিক নীতিমালা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয় (মহিউদ্দিন ফারুক, প্যারা ৪০)। জানার ইচ্ছে ছিলো, জনমূখী আইনী লড়াই-এর যে ‘স্লুইস-গেট’ (প্যারা ৫৪) মহিউদ্দিন ফারুকে আপনি গেঁথে ছিলেন, পরবর্তীতে এর ‘মিডিয়াইজেশান’ এবং ‘কসমেটিসিজম’ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে কিনা!
খুব জানবার ছিলো, মাত্র ছয় মাসের প্রধান বিচারপতি হওয়াতে আপনার কোনো অতৃপ্তিবোধ ছিল কিনা। জানি, যে আত্মপ্রচার বিমূখ মানুষ ছিলেন আপনি, এ নিয়ে আপনার খেদ ছিলোনা। কিন্তু আমাদের তো আফসোস থাকারই কথা। বঞ্চিত হলাম কি কোনো নতুন আইনবিজ্ঞান থেকে? যদি কিছু বেশি সময়ের জন্য থাকতেন! তাও ভালো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক সমীকরণে আপনি পড়েননি!
হেফজুর রহমান বনাম শামসুন্নাহার (১৯৯৯)-এ প্রশ্ন উঠেছিল তালাকপ্রাপ্তা নারী সাবেক স্বামী থেকে কতদিন যাবত খোরপোষ পাবেন। আমাদের হাইকোর্ট ভারতের শাহ বানো-র (১৯৮৫) উপর সাওয়ার হয়ে বললেন যে, অনির্দিষ্টকাল বা ওই নারী পুনারায় বিয়ে করা অবধি সাবেক স্বামী খোরপোষ দিতে বাধ্য। আপনি বিষয়টাকে শাহ বানো মুক্ত করে বললেন যে, কুরআনিক নীতির (ইদ্দতকাল অবধি) অন্যথা করার সুযোগ নেই। আপনার রায়ে নিন্দুকেরা ‘পিতৃ-তান্ত্রিকতার’ উপস্থিতি দেখলেন। আপনি শরিয়া আইনকে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-এর আলোকে দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন ইত্যাদি গোছের সমালোচনাও আপনার কানে গিয়ে থাকবে। আমার মনে হয়েছে দুঃস্থ পরিত্যাক্তা নারীর জন্য রাষ্ট্রকে আরো সুচারুভাবে আইন করার আদেশ দিয়ে আপনি আরো প্রতিকারমূলক ন্যায়বিচার স্থাপন করতে পারতেন। ওই মামলায় আপনার রায়সমর্থনকারী বিচারপতি লতিফুর রহমান অবশ্য এদিক দিয়ে আরো বেশি স্পষ্ট ছিলেন। কিন্তু আইনটি আর হলো কই?
স্যার, আইনে কি আবেগ একেবারেই থাকতে নেই, বিশেষ করে সে আবেগ যদি হয় একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনকারী সামষ্টিক আবেগ? তাই আপনি যখন কোনো রাজাকারের ভূমিকা বিচার করতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইনকে একটি জাতির রক্তস্নাত জন্মের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে ‘ব্যর্থ’ হন এই বলে যে, যুক্তিটি ‘আবেগে লম্বা কিন্তু আইনে খাটো’ [বাংলাদেশ বনাম. গোলাম আযম (১৯৯৪), পাতা ৩৪], তখন কেন জানি একটা অভিমান জন্মে আপনার উপর। আপনাকেই বা একা দোষ দিই কেমন করে, আমাদের আরেকজন বিদগ্ধ বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান যে একই চিন্তা করেছেন!
অবশ্য এর একটা মানে আমি বের করেছি। মানবাধিকারের জন্মগত ‘অ-প্রত্যাহারযোগ্যতা’ ধারণা পরিশীলীত করে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের সৌকর্য অনেক উপরে নিয়েছেন আপনারা। দেশদ্রোহীর-ও জন্মগত অধিকার (যেমন কবরস্থ হবার অধিকার. আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে জাতীয়তা পাবার অধিকার) কেড়ে নেয়া যায়না...এরকম উদাহরণতো কেবল সফোক্লিস-এর আন্তিগনির মুখেই শুনি স্যার, এমন ধারণা আইখম্যান-ইআমসিতাতে-ও নেই (১৯৬১ ও ১৯৪৫)।
অথচ দেখুন স্যার, এর সুবিধাভোগীরা ওই মানের বিচারিক মনের ফল খেয়েছে কিন্তু স্বভাবগতভাবে এখন তারা সেই সুপ্রিম কোর্টের মানকে ‘আন্তর্জাতিক’ মনে করেনা! রাগ লাগে সেখানেই!
আপনার বিচারিক দর্শনে সাংবিধানিকতাবাদ-এর স্থান আমাকে মুগ্ধ করে। সুপ্রিম কোর্টের উপদেশমূলক এখতিয়ার প্রশ্নে আপনার চিন্তার সবটুকুই বিস্ময়কর সুন্দর।
১৯৯৫ সনে ঐতিহাসিক রেফারেন্সের প্রশংসা করে আপনি ইতিহাসের অংশ হতে চেয়েছিলেন (এমপিদের গণপদত্যাগ বিষয়ক বিশেষ রেফারেন্স, ১৯৯৫)। আপনি লেখেন: “সরকার গায়ে মাখবেনা এমন ধারণা নিয়ে আদালত তার উপদেশমূলক এখতিয়ার অনুশীলন করেননা। বরং আদালত ভাবেন যে, আইনী প্রশ্নে উপদেশ চেয়ে যে সম্মান আদালতকে দেখানো হয়েছে, তা গ্রাহ্য করে সেই সম্মানের মুল্য রাখা হবে (প্যারা ৯৩)।
২০০৯ সনে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বিচার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়ে সেই সম্মানটুকু আবার করা হয়েছে। আপনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, আমাদের সংবিধানের ১০৬ নং অনুচ্ছেদ যতটা না রাষ্ট্রপতির কাজ সংক্রান্ত তার চেয়ে বেশি সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার সংক্রান্ত। কাজেই জনগণের জন্য দরদী কোনো রাষ্ট্রপতিকে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। উপদেশমূলক এখতিয়ার হবে রাষ্ট্রপতির জন্য জনস্বার্থ মামলার রূপক! কি সুন্দর বলেছেন আপনি! আইনের ভাষার একি শিল্পিত তরজমা!
স্যার, ৪৩ বছরে আমরা কি আমাদের সেরা মামলাটা লড়ে ফেলেছি? আমরা কি আমাদের সেরা বিচারিক রায়টি লিখতে পেরেছি? জানা হলোনা। আপনার জীবনকালে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা হলোনা। আপানার বাবার গানটা দিয়ে শেষ করি: “গুরুর পদে প্রেমভক্তি হলোনা মন হবার কালে, আর কিরে তোর সাধন ভজন হবে, অনুরাগে, সময় গেলে?...”। ভালো থাকুন ওই পারে। আমীন।
লেখক পি.এইচ.ডি গবেষক, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি ওয়েলিংটন।
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫