ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর আইন নেই

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৫
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর আইন নেই ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়।

  প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর সাথে জীববৈচিত্র্যের রয়েছে অস্তিত্বের সম্পর্ক। প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তন ও মানুষের প্রকৃতি বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ডের ফলে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, অন্যদিকে জীবের বিচরণক্ষেত্রে দস্যুদের আনাগোনা-অবাধ বিচরণ-এসব কর্মকাণ্ডে বিলীন হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
 
জীবের বিচরণ ও আশ্রয়স্থল জল বা স্থল সবই আজ ক্রমহ্রাসমান। একদিকে দূষিত জলরাশি আরেকদিকে বৃক্ষ ও বনাঞ্চলমুক্ত বিরানভূমি। পশু-পাখির অভয়ারণ্য আজ মানুষের বিচরণক্ষেত্র। আশ্রয়স্থল ও খাদ্য সংস্থানের অভাবে প্রাণীকুল হারাচ্ছে তার চিরচেনা আবাসভূমি, অথবা পাড়ি জমাচ্ছে অন্য কোনো স্থানে। খাদ্য ও উপযু্ক্ত পরিবেশের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে হয়তো কোনো একটি প্রাণী বা প্রজাতির শেষ বংশধরটিও।

একটি দেশের মোট ভুমির কমপক্ষে ২৫% ভাগ বনাঞ্চল থাকা বাঞ্ছনীয়। ১৬% সহনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে তার সিকিভাগও নেই। যা আছে তাও বিলীন হওয়ার পথে। কাজেই প্রাণীকূলও হারাচেছ তাদের বাসস্থান।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য কার্যকর আইন না থাকায় ও সেই সাথে জনসচেতনতার অভাবে জীববৈচিত্র্য আরো হুমকির মধ্যে পড়ছে। নির্ধারিত জীববৈচিত্র এলাকায় বা আশ্রয়স্থলে জনগণের অবৈধ প্রবেশ, সম্পদ আহরণ, গবেষণা ও মেধাসত্ত্ব লঙ্ঘনে শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র। এসব দেখভাল করার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা।

২০১৩ সালে সরকার একটি আইন করার পদক্ষেপ নিলেও তার বাস্তনায়ন এখনো সম্ভব হয়নি। খসড়া আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাবে জীববৈচিত্র বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আজও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। আইনে বর্ণিত শাস্তি কাগজেই রয়ে গেছে। বাস্তবে অপরাধীরা ধরা ছোয়ার বাইরে। আইনে ৫ বছরের শাস্তি ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু আইন প্রয়োগের চেয়ে তার বাস্তবায়নই বেশি জরুরি।
 
গত ১৩ জানুয়ারি বাগেরহাটে বাঘের চামড়া ও হাড়সহ আটক করা হয় তিনজনকে। সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ আর বান্দরবনের হাতি চোরাকারবারিদের প্রধান শিকার। শুধু তাই নয়, আরো অনেক প্রাণী আজ অর্থলোভীদের শিকারে পরিণত হয়েছে। এরফলে, অতিমূল্যবান বন্যপ্রাণী আজ হুমকির  মধ্যে পতিত।  

এভাবেই জীববৈচিত্রের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিচরণক্ষেত্র সুন্দরবন আজ মানুষের নানামুখি কর্মকাণ্ডের ফলে হুমকির মুখোমুখি। অবাধ বনসম্পদ আহরণ, পশু-প্রাণী নিধণ ও শিকার ও সেই সাথে জলজ ও বনজ সম্পদ আহরণের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্য মন্ডিত সুন্দরবন আজ হারাতে বসেছে তার চিরচেনা রুপ।  

আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে যেভাবে প্রাণীসম্পদ আহরণ করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবেনা। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত জীববৈচিত্র্য সনদের অধিকাংশ নীতি আজ অনুসরণ করা হচ্ছে না। জীববৈচিত্র্য সনদে এর যে গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে তার কোনো প্রতিফলন আমাদের দেশে নেই।

জীববৈচিত্র কোনো দেশের একক সম্পদ নয়। এটি সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ। এর বসবাস বা ব্যবহার হয়তো কোনো একটি দেশের বা জনগোষ্ঠীর নাগালের মধ্যে হতে পারে। কিন্তু এর এখতিয়ার সমগ্র মানবজাতির। জীবজগত একটি সার্বজনীন ও আন্তর্জাতিক সম্পদ। সে জন্যই এ সম্পদের রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

জীববৈচিত্র্যর সার্বজনীন গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই আন্তর্জাতিক আইনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে জাতীয় পর্যায়েও কৌশল প্রণয়ন, টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

খসড়া আইনে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জীববৈচিত্র্য আইন লঙ্ঘন করবেন তাদের ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে।  

জীববৈচিত্র্য বিষয়ক অন্যান্য আন্তর্জাতিক সনদেও বাংলাদেশ সাক্ষরকারী দেশ। ফলে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাংলাদেশ আর্ন্তজাতিকভাবে দায়বদ্ধ।   ১৯৭১ সালে রামসার সনদ, বিশ্ব হেরিটেজ সনদসহ আরো অন্যান্য সনদেও বাংলাদেশ সাক্ষর করেছে। প্রত্যেকটি সনদেই বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য ও জলাশয়, জলাধার, বনসম্পদ রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নীতি ও কৌশল প্রণয়নে বাধ্য।  

ওইসব আইনের আদর্শ অনুসরণ করে দেশে ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ সালের পরিবেশ রক্ষার বিধান করা হয়। শুধু তাই নয়, আমাদের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা আছে। এটি বর্তমানে আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে।  

সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র বিষয়ক অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। এখানে বলা হয়, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও   নিরাপত্তা বিধান করিবেন। ‘  ২০১১ সালের সংশোধনের মাধ্যমে এটি সংযুক্ত হয়।

জীববৈচিত্র্য সনদের ৫ অনুচ্ছেদে যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কথা বলা আছে তা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ, ভারত ও মায়নমার তার ভৌগোলিক সীমার কারণে অনেক ক্ষেত্রে একই জীববৈচিত্র্যের অধিকারী। এই তিনটি দেশ অনেক ক্ষেত্রে একই জীববৈচিত্র্য, প্রতিবেশ ও জীবপ্রজাতির উত্তরাধিকারী। কাজেই আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক আইনের আমাদের কার্যকর আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবী। জাতীয় পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য কার্যকর আইন, নীতি ও কৌশল প্রণয়ন ছাড়া আমরা এ সম্পদ রক্ষা করতে পারবোনা। তাই এ লক্ষ্যে অতিদ্রুত কার্যকর পদক্ষপ জরুরি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।