ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ ও তাদের অধিকার রক্ষায় ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন না হওয়াতে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।
আইন প্রণয়নের ফলে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভোক্তা তথা জনগণ এর সুফল পেতে শুরু করেছে। উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তা অধিকারকে নাগরিকদের সাধারণ দেওয়ানি অধিকার হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের দেশে নাগরিক অধিকারের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব না পাওয়াতে ভোক্তা অধিকারও প্রায়-গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত।
উন্নত বিশ্বে ‘ভোক্তা অধিকার’ নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এটি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। তারা বহুদিন থেকেই এধরনের আইন বাস্তবায়নের সুফল পেয়ে আসছে। নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। একটি কার্যকর ভোক্তা আইনের ফলে সেসব দেশে জনস্বার্থ তথা ভোক্তা অধিকার আজ একটি প্রতিষ্ঠত বিষয়।
ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা দাম দিয়ে ভেজাল পণ্য ও সেবা ক্রয় করি। এ নিয়ে নাগরিকরা কোনো প্রতিবাদ করে না। রাষ্ট্রও নির্বিকার। কিন্তু অন্যান্য দেশে ভোক্তা অধিকার লংঘনের কথা ভাবাও যায় না।
ভোক্তা অধিকার লংঘন করলে অনেক দেশে বিক্রেতার লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। শুধু তাই নিয়, আছে ফৌজদারি দণ্ডও। তাই আইনের বাস্তবায়নটাই বড় কথা।
যেকোনো দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু আমাদের মাঝে অর্থাৎ ভোক্তাদের মাঝেই সে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে, ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।
মিথ্যাচার, ভেজাল, ফর্মালিন আজ ভোগ্যপণের সাথে মিশে গেছে। এমনকি ওষুধ দিয়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। বাজারের শাক-সবজি, ফল-মূল সব কিছুতেই ফরমালিন।
আইন প্রণয়নের পর বিভাগ, জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় বাজার মনিটরিং ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এ লক্ষ্যে মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে অভিযান পরিচালনার সংবাদ দেখা যায়। এটিকে আংশিকভাবে এ আইন বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু জনগণের দোড়গোড়ায় এ আইনকে পৌছে দিতে হবে। সচেতন করতে হবে সবাইকে।
যদিও অতি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও জনগণ এর সুফল র্কিছুটা পেতে শুরু করেছে। সরকার আইন প্রণয়ন করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামে একটি অধিদপ্তর সৃষ্টি করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে কাজ করছে এ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৭টি বিভাগীয় কার্যালয় ও ৯টি জেলায় কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে সবকটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তবে, পুরোপুরি এর বাস্তবায়ন না হওয়াতে তৃণমূল ভোক্তাদের স্বার্থ এখনো পরাভূত। আইন বাস্তবায়ন না হওয়াতে ভোগান্তিতে আছে দেশের জনগণ। ভোক্তা অধিকার বলতে যে একটি বিষয় আছে সেটিই আমাদের মাঝে নেই। প্রতারণা যেনো আমাদের নিত্যসঙ্গী।
খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যে ভেজাল থাকবে এটি আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। সেই সাথে ওজন ও মানের তো কোনো বালাই নেই। পয়সা গুনেও আসল ও ভেজাল পণ্য পাওয়া যাবে না। কিন্তু শাস্তিতো অনেক পরের কথা এনিয়ে কথা বলাও অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।
জনগণের দীর্ঘ দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার আইন ও বিধি প্রণয়ন করলেও এর বাস্তবায়ন নাই। মূলত জনগণের পক্ষথেকেই এর বাস্তবায়নের জন্য তেমন ইতিবাচক সারা নেই। আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে কিছু ধরপাকর ও জরিমানা এই যা কার্যক্রম। এর বাইরে ব্যাপকহারে জনগণের মাঝে তেমন কোনো সারা নেই। ফলে এর সুফল পেতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু জনগণের এ দূর্বলতা কাজে লাগিয়ে অনৈতিক লাভ করে যাচ্ছে অতিমুনাফাখোর একটি চক্র। এ চক্র ভেদ করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা প্রায় দুরুহ। তাই দেখেও না দেখার ভান। সবকিছুই গা সহা হয়ে গেছে।
আইনে আছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংস্থা থাকবে। আইনানুযায়ী তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী পদাধিকার বলে এর চেয়ারম্যান ও বাণিজ্য সচিব, এনএসআইয়ের মহাপরিচালক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম-সচিব, বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবসহ ২০ জন সদস্য নিয়ে এ পরিষদ গঠিত।
২০০৯ সালের আইনটি হওয়ার আগে কমবেশি ৪০ টি আইন ও ধারা বিচ্ছিন্নভাবে ভোক্তা অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে সবগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয় একসাথে করা হয়।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে আরো যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫, অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী আইন ১৯৫৬, নিরাপদ খাদ্য আইন ১৯৫৯, পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০, ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২ ও এক্রেডিটেশন বোর্ড আইন ২০০৬। সবগুলো আইনেই ভোক্তা অধিকারের কথা বলা আছে।
তবে ২০০৯ সালের আইনের একটি বড় সমস্যা হলো এখানে ভোক্তাদের অধিকারগুলো কি কি তা বর্ণনা করা হয়নি। তবে অধিকার লংঘন হলে ভোক্তা বা কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে। আইনটি ভোক্তা অধিকার কাউন্সিল ও অধিদপ্তরকেউ গুরুত্ব দিয়েছে। অধিকারভিত্তিক ও সে অধিকার রক্ষামূলক মনোভাব আইনে অনেকটাই অনুপস্থিত।
ভারতে কর্তৃপক্ষ ভোক্তা অধিকার লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি উপ-আইনগত ব্যবস্থা-quasi-judicial step। ১৯৯৬ সালের আইনানুযায়ী সে অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে জাতীয়, রাজ্য ও জেলা পর্যায়ে তিনস্তর বিশিষ্ট আইনী পদ্ক্ষেপ নেওয়ারই বিধান আছে।
আমাদের আইনের ১০ (১) ধারা অনুযায়ী যে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছে তা কতটা কার্যকর এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে লোকবলের অভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
আইনানুযায়ী (৫ ধারা) জাতীয় ভোক্তা অধিকার পরিষদ নামে একটি পরিষদ আছে। এ পরিষদে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট ২৪ জন সদস্য আছেন। মাননীয় বাণিজ্য মন্ত্রী এই পরিষদের প্রধান। আছেন অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও। তারা আড়াই বছরের জন্য মনোনিত হন।
এই পরিষদের কাজ হচ্ছে, আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে মহাপরিচালক ও জেলা
কমিটিকে নির্দেশনা প্রদান করা ও প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন করা।
এছাড়া এ পরিষদ ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কে সরকার কর্তৃক প্রেরিত যে কোন বিষয় বিবেচনা করবে ও মতামত প্রদান করবে।
এ পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, ভোক্তা-অধিকার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।
আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হলে ভোক্তা অধিকার অনেকাংশেই সংরক্ষিত হবে। এজন্য কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬