ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

ধর্ষিতার পরিচয় ও আমাদের দায়বদ্ধতা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৬
ধর্ষিতার পরিচয় ও আমাদের দায়বদ্ধতা

ধর্ষণের আইনগত ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ আমাদের সবারই জানা। বাংলার গণমাধ্যমের পাঠক ও দর্শকমাত্রই এখন ধর্ষণ বিষয়ে দু’একটি কলাম লিখে ফেলতে পারবেন।

ইন্টারনেটের কল্যাণে ভিডিওসহ ধর্ষণের কাহিনী এখন হাতের মুঠোয়।

২০১২ সালের যখন দিল্লি যাই, সে শহর তখন ‍উত্তাল। দিল্লি ধর্ষণকাণ্ডের পর ভারত সন্তানরা তখন রাজপথে। আমরা বঙ্গসন্তানরা এখান থেকে হাপিত্তেস কম করিনি। ভারতের এটা করা উচিত, ওটা করা ঠিক হয়নি, ইত্যাদি-ইত্যাদি। মাসও পেরোতে পারেনি, আমাদের সাভার, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর দিল্লিকে দেখিয়ে দিয়েছে ধর্ষণ কাকে বলে। ভারত করলে হয় রামলীলা আর আমরা হলে ব্যভিচার। এ অনাচার মেনে নেওয়া যায়না। নেবোই বা কেন? ধর্ষণে শতরান করে পার্টি দেয়া লোক আমরা। রসুখা আমাদেরই ভাই!

এ বর্ণনা এখানে ক্ষান্ত দিয়ে ধর্ষিতার দিকে একটু তাকাতে চাই।

কয়টা ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন? আর কয়টাইবা মিডিয়ায় আসে? আসলেও কয়টাই বা চাউর হয়। শেষটার কথাই বলি। তনুকে আমরা চিনতাম না। জানতামও না কে এই মেয়ে। এখন আমরা ‍তার পুরোটাই জানি। তার জন্ম, শৈশব, বেড়ে ওঠা, স্কুলে যাওয়া, বন্ধুত্ব, মেলা-মেশা, সেলফি, বয়ফ্রেন্ড (যদি থাকে), আড্ডা আরো কত কি! তনু মরিয়া প্রমাণ করিলো যে সে মরে ‍নাই! বঙ্গভূমির সব নারীই যে কাদম্বিনী।

আমি আইনের ছাত্র। আইনের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু তারপরও কিছু কথা না বললেই নয়, তাই ওপরের দু’একটি বাড়তি কথা আর কি!

মাঝে মাঝে মনে হয়, আইন দিয়ে জগতে কিছু হয় না। সব বড় বড় কথা। আসলে অস্টিনই ঠিকই বলেছিলেন, ‘Law is the command of the sovereign’। কথাটি আরো সত্য মানি যখন তার শেষ কথাটি ‘backed by the threat of punishment’ স্মরণ করি। আসলে আইন হলো সবলের শক্তি, আর দুর্বলের বোঝা। আইন কাজে লাগিয়ে কেউ হয় সুবল নয়তো সুশীল। বাকিরা সব বেয়ারা।

ধর্ষণের আইনগত বিশ্লেষণ পাঠকের জানা। কিন্তু কত ধর্ষণ যে থেকে যায় আড়ালে আবডালে তা কি আমাদের জানা আছে? প্রতিদিনই বাড়ছে এসব ঘটনা। এখনতো প্রায় গা সহা হয়ে গেছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখানে আইন আছে, বিচার নেই। তাই আইনের কোনো সুফল নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় ধর্ষণের শিকার ও তাদের পরিবার ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চায় না।

দেড়শ’ বছর আগে এখানে ধর্ষণবিরোধী আইন হয়। দণ্ডবিধিতে ধর্ষণবিরোধী আইন পাকাপোক্ত। ১৫৬ বছরেও এর তেমন কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন পড়েনি। আমরা কথায় কথায় আইনের দোহাই দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। শুধু ধর্ষণ কেন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনেক আইনই আছে দেশে। তারপরও আমরা প্রয়োজনের তাগিদে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করেছি। কিন্তু নারী নির্যাতন তাতে কিছু কমেনি। শিশু নির্যাতন আরো বেড়েছে। তাই মূল কথা হলো আইন থাকলেই হবে না, আইনের প্রয়োগ চাই, ন্যায়দণ্ড সবার জন্য সমান হওয়া চাই।
 
১৮৬০ সালে ব্রিটিশরাজ ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন করেছিলেন। জরিমানার ব্যবস্থাও করে গেছেন ফিরিঙ্গিরা। ২০০০ সালে আমরা যে নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইন করেছি তাতেও যাবজ্জীবনের ব্যবস্থাই করেছি। ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হলে ‍আছে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও। অপরাধটি আমলযোগ্য ও ‍জামিন অযোগ্য। কিন্তু তারপরও আমরা দেখছি, বাইরে আসামির আস্ফালন, চার দেয়ালে বন্দি ধর্ষিতা নারী।

‘গণমাধ্যম’র কল্যাণে (?) আমরা এখন ধর্ষিতার নারী-নক্ষত্রও জানতে পারছি। ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’র কল্যাণে ধর্ষিতার ছবি (ভিডিওসহ) পুরো রগরগে কাহিনী এখন হাতের মুঠোয়। আইনের বালাই নেই। সংবিধানের পাত্তা নেই। সবই এখন আমাদের ‘তথ্য অধিকার’র আওতাভুক্ত।

সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের যে ন্যূনতম ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার দিয়েছে গণমাধ্যমে ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ করে সে অধিকারটিও কেড়ে নিচ্ছি। কিন্তু ধর্ষিতার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার তো অনেক পরের কথা, তার নাম-পরিচয় প্রকাশে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ধর্ষিতার ছবি এমনকি পারলে ভিডিওও প্রকাশ করার মহড়া চলে। ধর্ষণপরবর্তী ছবি প্রকাশও করতে ছাড়ে না কোনো কোনো অখ্যাত গণমাধ্যম।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ছবি বা ভিডিও মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। এসব কাজ করতে গিয়ে আমরা কখনোই একজন ধর্ষিতার কথা ভেবে দেখিনা। ভেবে দেখিনা তার ব্যক্তিগত মান-মর্যাদার কথা। আমরা কখনোই চিন্তা করি না ওই নারীর পরিবার তথা আত্মীয়-স্বজনদের কথা। একজন নারী কোনো দোষ বা অপরাধ না করেও সব ধরনের সামাজিক দণ্ডই তাকে ভোগ করতে হয়। আর আইনগত দণ্ডতো একটি প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার।

২০০০ সালের আইনের ১৪ ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ না করার কথা বলা আছে। বিশেষ করে ধর্ষণকালের ও ধর্ষণপরবর্তী (during or after attack) ছবি প্রকাশে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। আইনানুযায়ী এজন্য শাস্তিরও ব্যবস্থা আছে যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে। জরিমানা হতে পারে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু আমরা কি এসব বিধান মেনে চলছি?

আইন মানুক আর নাই মানুক গণমাধ্যম তো তবুও আইনের আওতায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে এখনও এসব আইনের আওতায় আনা যায়নি। রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান, সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এসব ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যতটা নজরদারিতে; নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকার ও মান-মর্যাদা রক্ষায় সে নজরদারিটা নেই। এসব ব্যাপারে কার্যকর আইন করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে মানুষের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসবে। কিন্তু তার মাধ্যমে যদি নাগরিকের ব্যক্তিগত মান-মর্যাদার হানী হয় সেটি কাম্য নয়। সামাজিক মূল্যবোধ ভুলুণ্ঠিত করা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লক্ষ্য নয়।

তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সমাজ ও রাষ্ট্রে কল্যাণ বয়ে আনে, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজ বিনির্মাণ হয় আধুনিক চিন্তা-চেতনায়। ইন্টারনেট আমাদের পুরাতন ভাবনা ও চিন্তার জগতের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের আরও আপন করেছে। শুধু মূল্যবোধটা একটু শক্ত করে ধরতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৬
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।