ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের কারণে গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান নয়’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
‘উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের কারণে গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান নয়’

ঢাকা: ‘কিছু উচ্ছৃঙ্খল র্যাব সদস্যের কারণে র্যাবের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিস্যাৎ হতে পারে না। কিন্তু এই বাহিনীর কিছু সদস্যের শয়তানি প্রবৃত্তি মানব সভ্যতার মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে’।

সাত খুনের রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

আদালত বলেন, ‘র্যাব রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিশেষ বাহিনী।

তাদের দায়িত্ব হলো, জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু এ বাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ সংঘটিত করেছেন। ফলে তাদের বিচার হয়েছে। দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এ বাহিনীর প্রতি মানুষের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। কিন্তু কিছু সদস্যের কারণে সামগ্রিকভাবে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না’।
 
বিকেলে দেওয়া সাত খুনের দুই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ে প্রধান ৪ আসামিসহ ১৫ জনের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ২৬ আসামির মধ্যে অন্য ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এ মামলার মোট ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডও বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট।  

মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা  প্রধান ৪ আসামি হচ্ছেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং র্যাব-১১’র চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা।

অন্য যে ১১ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রয়েছে, তারা হলেন- ৠাবের চাকরিচ্যুত সাবেক হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব আলী,  কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ ও সৈনিক তাজুল ইসলাম। তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরীফ ও তাজুল ইসলাম পলাতক।

অন্যদিকে সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ আসামি হচ্ছেন- ৠাবের চাকরিচ্যুত সাবেক সিপাহী আসাদুজ্জামান নূর ও সার্জেন্ট এনামুল কবির এবং নূর হোসেনের ৯ সহযোগী মূর্তজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, আবুল বাশার, রহম আলী, জামাল উদ্দিন সরদার, ভারতে গ্রেফতারকৃত সেলিম, সানাউল্লাহ সানা ও শাহজাহান। তাদের মধ্যে সেলিম, সানাউল্লাহ সানা ও শাহজাহান পলাতক।

বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ৯ জনও র্যাবের বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা ও সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল (পরে এএসআই পদে পদোন্নতি পেয়ে নৌ-থানায় কর্মরত) হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহী নুরুজ্জামানের ১০ বছর করে এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিন ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে উচ্চ আদালতে। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান ও কামাল হোসেন পলাতক।

সব মিলিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ৩৫ জনের মধ্যে কারাগারে আছেন ২৭ জন আর পলাতক ৮ জন।

২৬ জনের মধ্যে গ্রেফতার ও আত্মসমর্পণ করে কারাগারে থাকা ২০ জন নিয়মিত ও জেল আপিল করেন। পলাতক অন্য ৬ আসামি আপিল করেননি। আপিলগুলোর আংশিক মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছেন, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যান- তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে’।
 
‘যে সাতজনকে হত্যা করা হয়, র্যাব হেফাজতে তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা ছিল ভয়াবহ ও অকল্পনীয়। ওই র্যাব সদস্যরা এতোটাই নির্দয় ছিলেন যে, তাদেরকে হত্যার পর তলপেট ছুরি দিয়ে কেটে তাদের বস্তাবন্দি করেন। প্রতিটি বস্তার সঙ্গে ১০টি ইট বেঁধে দেওয়া হয়, যেন মরদেহ নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। তাদের এ নৃশংসতা প্রমাণ করে যে- মৃতদেহের ওপরও তারা কতোটা নির্দয় ছিলেন’।
 
আদালত রায়ে আরও বলেন, ‘আসামিরা যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে উঠে এসেছে যে- এ হত্যাকাণ্ডটি ছিল সুপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। এবং আর্থিক লেনদেন হয়েছে নূর হোসেনের সঙ্গে’।

‘এই নূর হোসেনই হলেন এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। তার সঙ্গে ছিলেন তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ ও কমান্ডার মাসুদ রানা’।
 
সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ জনের বিষয়ে হাইকোর্ট বলেন, অপরাধের ধরন বিবেচনায় নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে- সেটি হবে কঠোর শাস্তি। তাই তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত’।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণের তিনদিন পর তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ওই ঘটনায় নিহত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।

সাত খুনের ঘটনায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার ৪ সহকর্মী হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

দু’টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম একসঙ্গে শেষ করে গত ১৬ জানুয়ারি নূর হোসেন ও র্যাবের বরখাস্তকৃত তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালত। ৩৫ জন আসামির বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।