তবে বাংলায় রায় দিতে হলে বাংলায় আবেদন করার কথাও আদালত অঙ্গনে আলোচনায় উঠে এসেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলায় রায় লেখা নিয়ে আলোচনা হলেও সুপ্রিম কোর্টের জাদুঘরে রক্ষিত এক নথিতে দেখা গেছে, ১৮৬৭ সালে দেওয়া এক মামলার কার্যক্রম রয়েছে বাংলায়।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মতে, উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে বিচারপতি এআরএম আমিরুল ইসলাম চৌধুরী হচ্ছেন পথিকৃৎ। তিনি সর্বপ্রথম সব আদেশ-নির্দেশ ও রায় বাংলায় দেওয়া শুরু করেন। আর ২০০৭ সাল থেকে এবিএম খায়রুল হক নিজেই বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করেন।
হাইকোর্ট বিভাগে প্রায় দেড় শতাধিক রায় দেন তিনি। সর্বশেষ আপিল বিভাগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বলে দেওয়া রায়ও বাংলায় দেন।
সম্প্রতি পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর মাতৃভাষা বাংলায় ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা লিখেছেন। এছাড়া বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বাংলায় রায় লিখে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমও বাংলায় রায় লিখেন।
তবে এ পর্যন্ত সর্বাধিক বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন। যিনি ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর পরে তিনি স্থায়ী হন। তার এ রায় ও আদেশের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের মতো।
২০১১ সালের ২৬ মে ‘জুয়েল শিকদার বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় দেওয়া রায়টি লিখেছেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন। রায়ে তিনি বলেছেন, ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া উৎকৃষ্ট (দরখাস্তকারীর কাছে তর্কিত) রায়টি যদি দরখাস্তকারীর বোধগম্য ভাষায় প্রদত্ত হতে, তাহা হলে দরখাস্তকারীকে হাইকোর্ট দেখিতে হতে না বা তাহাকে কেহ হাইকোর্ট দেখানোর দুঃসাহস করিত না, দরখাস্তকারীর বোধগম্য ভাষায় এটি প্রচারিত হলে তাহার তথ্য-উপাত্ত, পরিশেষে উপসংহারে প্রদত্ত সাজা কেন তাহাকে দেওয়াছে, তিনি কি সত্যিই দোষী? উক্ত সাজা সঠিক কি বেঠিক? তাহা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন।
রায়ে আরও বলা হয়, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণের কথা আজও জাতিকে চরমভাবে নাড়া দেয়। ’ সেদিন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকে দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে। ’
বিচারপ্রার্থী তাহার নিজের বোধগম্য ভাষায় বিচার না পাওয়ার বোধগম্যতার অভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বিভ্রান্ত হওয়ায় আদালতগুলোতে এত মামলা মোকদ্দমার জট। এ জট খুলতে পারে শুধু মাত্র বিচারপ্রার্থীদের বোধগম্য ভাষায় তাহাদের বিচারের বাণী প্রকাশ এবং প্রচার, তাহা না হইলে সেই চির পরিচিত মর্মবেদনার বাণী বরাবরই প্রতিধ্বনিত হবে। ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। ’ -বলে রায়ে উল্লেখ করেন এই বিচারপতি।
বাংলাদেশ সময়: ০২০১, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০
ইএস/এএটি