ঢাকা: জাপানি নাগরিক ডা. নাকানো অ্যারিকো ও বাংলাদেশি আমেরিকান শরীফ ইমরানের দুই মেয়েকে অস্বস্তিকর উল্লেখ করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে হোটেলে স্থানান্তর করতে আবেদন করা হয়েছে।
মেয়েদের বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে বুধবার উচ্চ আবেদন করেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
এর আগে গত ২৩ আগস্ট এক আদেশে আদালত ওই দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন।
আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, বাবার প্রস্তাব হচ্ছে একটা হোটেল বাচ্চাগুলো রাখার জন্য। তিনটা রুমে। একটা রুমে মা, আরেকটা রুমে বাচ্চারা এবং অপর রুমে বাবা। সিকিউরিটির জন্য দুইজন মহিলা পুলিশ রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে দুই রুম এবং পুলিশের খরচ বাবা দেবেন।
তিনি বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। তাই মেয়েদের সুবিধার জন্য এ আবেদন।
এর আগে ২৩ আগস্ট আদেশে আদালত বলেছেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অ্যারিকো এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত ইমরান তাদের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
এই সময়ের মধ্যে দুইপক্ষ একটি ভালো সমাধানে আসবে বলে আশা করেছেন উচ্চ আদালত।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন।
আদালতে শিশুদের বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। শিশুদের মায়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শিশির মনির।
শিশির মনির জানান, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. নাকানো অ্যারিকো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইন অনুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বাসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তিনটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারা হচ্ছে জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) এবং সানিয়া হেনা (৭)। অ্যারিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরান তার স্ত্রী অ্যারিকোর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) আবেদন করেন। এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু তাতে অ্যারিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাব নাকচ করে।
পরে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপেজ থেকে ইমরান তাদের বড় দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। চারদিন পর ২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে অ্যারিকোর কাছে বাচ্চাদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু অ্যারিকো তা প্রত্যাখ্যন করেন। এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে তার বাচ্চাদের জিম্মার জন্য অন্তর্র্বতীকালীন আদেশ চেয়ে মামলা করেন অ্যারিকো। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেন। ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন।
এদিকে ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
শিশির মনির আরও জানান, ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত অ্যারিকোর অনুকূলে জেসমিন ও লিনার জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেন। ছোট মেয়ে সানিয়া হেনাকে মায়ের কাছে রেখে ১৮ জুলাই অ্যারিকো শ্রীলংকা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু ইমরান শ্রীলংকা থেকে অ্যারিকোকে ফিরে যেতে বলেন। অ্যারিকো বাংলাদেশে কোভিড পরীক্ষা করান এবং এর ফলাফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু ইমরান কোভিডের ফলাফল অবিশ্বাস করে অ্যারিকোর সঙ্গে সন্তানদের সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে ২৭ জুলাই মোবাইল সংযোগ বন্ধ ও চোখ বাঁধা অবস্থায় অ্যারিকোকে তার মেয়েদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয় এবং একই অবস্থায় গাড়িতে করে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় অ্যারিকো সন্তানদের নিজের জিম্মায় চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন বলে জানান আইনজীবী শিশির মনির।
এরপর শুনানি নিয়ে ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট ৩১ আগস্ট ওই দুই শিশুকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এক মাসের জন্য তাদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন উচ্চ আদালত।
এরমধ্যে রোববার (২২ আগস্ট) রাতে দুই শিশুকে হেফাজতে নেয় সিআইডি।
২৩ আগস্ট আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ আদালতে বলেন, মাই লর্ড আপনারা রুল ইস্যু করেছিলেন। আদেশে আপনারা আগামী ৩১ আগস্ট আদালতে শিশু দু’টিকে হাজির করতে বলেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে ২২ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টায় সিআইডি বাসায় চলে যায়। সেখান থেকে বাচ্চা দু’টিকে সিআইডি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে বাচ্চাদের জেরা করা হয়েছে। এভাবে চালানোর পরে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, আমি একটা সম্পূরক আবেদন নিয়ে আসতে চাচ্ছি, সেটা যদি দুপুর ২টায় শোনেন, তখন আদালত আবেদনের অনুমতি দেন।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, মাই লর্ড আপনাদের দু’টি আদেশ ছিল, তার মধ্যে একটি হলো বাচ্চা দু’টিকে হাজির করা। আরেকটি হলো বাচ্চা দু’টিকে নিয়ে কেউ যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে। আমাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে ফোন দিয়ে বলা হলো- বাচ্চার মাকে সিআইডি অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ বাচ্চাদের তারা সেখানে রেখেছেন। জোর করে নিয়ে এসেছেন, তারা কিন্তু সেটা বলেননি। পরে আমিও সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে ৩০ মিনিট বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মায়ের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। আমি তখন সিআইডিকে বলেছি, তারিখ তো আরও পরে, এখনই বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন কেন? তখন তারা (সিআইডি) বললেন, হাইকোর্টের আরেকটি আদেশ আছে দেশ ত্যাগের বিষয়ে। সেই আদেশটা যেন শেষ পর্যন্ত প্রতিপালন করতে পারি, সেই কারণেই এ পদক্ষেপ নিয়েছি। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি এটা হাইকোর্টকে জানাতে হবে।
পরে আদালত আবেদন দাখিলের ২৩ আগস্ট শুনানি ও আদেশ হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০২১
ইএস/এসআইএস