ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘যখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম তখন ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১
‘যখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম তখন ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার’

ঢাকা: ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট।

আদালত বলেছেন, সরকার তো ব্যবস্থা নিচ্ছে, কখন? যখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, তখন।

সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের প্রাথমিক শুনানিতে সোমবার (২০ সেপ্টম্বর) এমন মন্তব্য করেন বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি জাকির হোসেনের বেঞ্চ।

আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক।

শুনানিতে সায়েদুল হক সুমন বলেন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ছাড়া আর কারো সুদের ব্যবসা করার সুযোগ নেই। কিন্তু সারা দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দেদারসে উচ্চহারে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, এমনকি মধ্যবিত্তও।

আদালত বলেন, আপনি যে তাদের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করেছেন, তারা তো সনদ বাতিল করেছে।

তখন রিটকারী বলেন, সনদ বাতিল (১৩৪ ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান) হলেও তাদের ব্যবসা থেমে নেই। তাহলে সমাজে সুদের ব্যবসা কীভাবে হচ্ছে?

এ সময় আদালত সনদ বাতিল করা ১৩৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান ফের ক্ষুদ্রঋণের কারবার করছে কিনা, তা  জানতে চান। কিন্তু আইনজীবী তা দেখাতে পারেননি।

আইনজীবী সুমন বলেন, মাইক্রোক্রেডিট অথরিটি চাইলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন, ২০০৬ এর ৩৪ ধারা অনুযায়ী সুদের ব্যবসাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে ৪১ ধারা অনুযায়ী এ অথরিটির কাছে অন্য কেউ অভিযোগ করতে পারবে না। অভিযোগ করতে হবে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কর্তৃপক্ষকে। এইসব কারণেই কিন্তু প্রতারক চক্র গড়ে উঠছে। মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তদারককারী হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা তো তদারক করছে না। এই জন্য তাদের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে রিটে।

এক পর্যায়ে আদালত বলেন, রাগীব (এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব এহসান) নামে এক হুজুর আগে শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার টাকা দিয়ে হচ্ছে না। তখন ইসলামের দোহাই দিয়ে সুদমুক্ত হালাল টাকা—এই সমস্ত কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছেন।

জবাবে আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন বলেন, এগুলোই চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। এরা মানুষকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষগুলো পথে বসে যাচ্ছে।

আদালত এই ইস্যু নিয়ে আরও গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেন।

এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর রুল হতে পারে না। কার ওপরে এ অভিযোগ আনা হয়েছে? কারা এই কাজগুলো করছে, তাদের নামগুলো সুনির্দিষ্ট করার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তারা প্রতিকার চাইতে পারেন।

তখন আদালত বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যাদের কোনো রেজিস্ট্রেশন নাই, তারা দেশ থেকে চলে গেল। টাকা চুরি করে সাফ করে দিয়ে গেল। কে কোথায় কত সালে কত হাজার টাকা নিয়ে গেল, এই যে নিয়ে গেল আমাদের রাস্তাগুলো খোলা কেন? আমার বাড়ি অরক্ষিত কেন? আমার বাড়ি মানে বাংলাদেশ। দেশের মানুষ দরজা-জানালা বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমাবে, কিন্তু আমার ঘর কেন অরক্ষিত? আমাদের ঘরের দরজাগুলা কেন খোলা? মানুষের টাকা কেন লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে? এই দরজাগুলো খোলা কেন? কাদের দায়িত্ব এই দরজাগুলো বন্ধ করার, এগুলো আমরা একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাই। আমরা দেখে শুনে আদেশ দেব।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা কিন্তু না। এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান-ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ সময় আদালত বলেন, সরকার তো ব্যবস্থা নিচ্ছে, কখন? যখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, তখন। আমার প্রতিকারটা কোথায়?

আদালত আরও বলেন, আমার টাকাটা নিয়ে গেল। আর আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরব? তারা থানায় যাবে, জেলে যাবে, রাত্রে ঘুমাবে। কিন্তু আমার টাকাটা যে নিয়ে গেল, সেটার কী হবে?

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুর উস সাদিক বলেন, চুরির পরে মামলা হচ্ছে। চুরি তো হচ্ছেই। চুরির বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু চুরি তো ঠেকানো যাচ্ছে না।

এরপর আদালত আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন রেখেছেন।

একটি জাতীয় দৈনিকে ‘চড়া সুদে ঋণের জালে কৃষকেরা’ শিরোনামে গত ২৮ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক রিট করেন। রিটে মহাজনদের উচ্চহারে অনানুষ্ঠানিক ঋণ প্রদান নিষিদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়।

এছাড়া চড়া সুদে অনানুষ্ঠানিকভাবে মহাজনদের ঋণ দেওয়া রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা/ ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ব–বহির্ভূত ঘোষণা এবং সারা দেশে চড়া সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, সে বিষয়েও রুল চাওয়া হয়েছে রিটে।

আবেদনে অর্থসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইনসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ ১৩৬ ব্যক্তিকে বিবাদী করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।