ঢাকা, সোমবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

কুয়াশা কিংবা মহুয়াতলার গল্প

মহিউদ্দীন আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২
কুয়াশা কিংবা মহুয়াতলার গল্প

জানুয়ারি সাত। মিষ্টি সন্ধ্যা।

চারদিকে থমথমে কুয়াশা। আকাশে ভরা-পূর্ণিমার চাঁদ। মহুয়াপাতার ফাঁকে ফাঁকে জোসনার লুকোচুরি।
কলাভবনের সামনে মহুয়াতলার বেদিতে পাশাপাশি বসে আছে নীরব আর কলি।  

কলি বিস্মিত হয়ে চাঁদের দিকে তাকালো। আর নীরব তাকালো ধবধবে শাদা সালোয়ার কামিজের সঙ্গে লাল সোয়েটার পরিহিত পরীরূপী কলির দিকে। কিছুটা অস্বস্তি হলো বুঝি কলির! তাই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নবোধক কণ্ঠে বললো, ‘কী?’
হুট করে ধেয়ে এলো নীরবের সলাজ সঙ্কোচ! বললো, ‘না, কিছু না!’
‘তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে অমন উৎসুকভঙ্গিতে কী দেখছিলে?’
‘বললাম তো কিছু না!’
‘তুমি কিছু লুকাচ্ছো!’    
‘আরে না!’
‘আ”ছা ঠিক আছে। তাহলে দ্যাখো, আজকের চাঁদটা কী সুন্দর! আর কলাভবনের মাঠটার দিকে একবার তাকাও! সবুজ ঘাসের ওপর চাঁদের আলো পড়েছে। আর ঐ যে দ্যাখো, বিশাল মাঠের ছোট ছোট কাশফুলগুলো কেমন ঢেউয়ের মতো দুলছে! দ্যাখো না!’
‘হুঁ। ’Ñবলে হাতের আঙ্গুল ফোটাতে শুরু করলো নীরব। আড়মোড়া ভাঙলো অস্বস্তির।
‘ধ্যাৎ!’ কলি কীরকম বিরক্ত হলো নীরবের ওপর! এমন একটা দৃশ্য দেখে কেউ শুধু ‘হুঁ’ বলতে পারে?
নীরব এবার সরাসরি কলির চোখের দিকে তাকালো।
‘সেকি! আমি তোমাকে মাঠের দিকে তাকাতে বললাম আর তুমি তাকাচ্ছো আমার দিকে?’
নীরব বললো, ‘তোমাকে আজ ঠিক পরীর মতো লাগছে!’
কলি খুবই অবাক হলো, ‘একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘বেশি হলে বেশি! আমি নিখাদ সত্য বলছি!’
কলি বললো, ‘আমাদের সম্পর্কটা কী তেমন? একদম ঠিক হচ্ছে না কিন্তু!’
‘একশোবার ঠিক হচ্ছে। ’
সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠলো কলির কণ্ঠস্বর, ‘নীরব! রিমেম্বার! উই আর অনলি ফ্রেন্ড!’
নীরব বললো, ‘ডোন্ট কেয়ার!’Ñবলে কলির ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিলো, ‘আই হ্যাভ স্ট্রেইঞ্জ  ফিলিং ইন মাই মাইন্ড!’
শুনে কলি যারপর-নাই হতাশ। নীরবের হাতের মধ্যে লজ্জাবতীর মতো নূয়ে রইলো ওর নির্মোহ ঠাণ্ডা হাত। যেন বা ওর হাতের শিরা-উপশিরার রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছে।
কলি অস্ফুট কণ্ঠে বললো, ‘ও মাই গড! ইটস ইমপসিবল নীরব!’ তারপর কেঁদে ফেললো। হাঁটুতে মুখ গুঁজে গুম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ।
নীরব কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওর মাথা ধরে এলো। ছেড়ে দিলো কলির হাতখানা। চুঁইয়ে পড়া জলের মতো আস্তে করে সরে গেলো কলির নরম হাত। টুপ করে এক ফোঁটা শিশির পড়লো কলির ভেজা চোখের পাতায়।
অদূরে স্তব্ধ কুয়াশার দীঘি। সুনসান নিরবতা।

তখন ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিলো। মস্তবড় চাঁদটা শিরীষ গাছের আড়ালে ঢাকা পড়েছিলো অল্প সময়ের জন্য। দুজন মানব-মানবীর নিরবতা ভাঙার কোনো অবলম্বন ছিলো না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দুই তিন মাসের মধ্যেই নীরব আর কলির পরিচয়। কলি ভালো গান করে। নীরবও সংস্কৃতিমনা। একসঙ্গে বেশ কিছুদিন চলার পর দুজনে আবিস্কার করে, অনেক বিষয়ে দুজনের মধ্যে দারুণ মিল।

ফলে ঘটা করে প্রথম প্রস্তাবটা কলির। একদিন হলের ল্যান্ডফোনে ফোন করে নীরবকে। তখন রাত এগারটা ছাড়িয়ে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দি”িছলো নীরব। হঠাৎ দারোয়ানের কল শুনে বন্ধুরা বলে উঠেছিলো, ‘যাও যাও মামু, অভিসার সাইরা আসো। ’
সেই রাতেই কলি প্রস্তাবটা দেয় নীরবকে।
নীরব তো মহা অবাক, ‘আরে বাবা, এইভাবে কেউ কাউকে প্রস্তাব দেয়?’
কলি বলেছিলো, ‘রিলেশনের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসটা অটুট রাখতে হলে এরকমই হওয়া দরকার। তুমি বলো, রাজি কি-না?’
নীরব বলেছিলো, ‘অফকোর্স। ’

সেদিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নীরব কলির দিকে তাকালো। বললো, ‘একজন বন্ধু কী অপর বন্ধুকে পরী বলতে পারে না?’
কলি হয়তো ভারমুক্ত হলো, ‘তা পারে। কিš‘ তুমি যেভাবে বলছিলে, ওভাবে হয়তো পারে না। ’
‘কীভাবে পারে শুনি?’
‘তা আমি কেমন করে জানবো?’
‘আ”ছা ঠিক আছে। এতো কিছু জানার দরকার নেই। চলো উঠি। ’
‘কোথায়?’
‘হলে। তুমি তোমার হলে যাও। আর আমিও আমার হলে। ’
কলি বললো, ‘রাগ করছো, নাকি অভিমান?’
‘রাগও না অভিমানও না;Ñদুর্ভাগ্য!’
‘মানে!’
নীরব কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, ‘মানে আর কী! পরীর মতো লাগছে বলে তোমাকে পরী বলেছি, এতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে। তা বাবা আমার কী এমন দরকার পড়েছে মহাভারত অশুদ্ধ করার? চলো। ভুলেও আর কখনো এমন কথা বলবো না। ’
‘তুমি রাগ করছো? প্লিজ রাগ কোরো না!’
‘না না। রাগ করবো কেন?’
‘তাহলে চলে যেতে বলছো কেন? কেবল তো সাড়ে সাতটা বাজে। এখন হলে গিয়ে কী করবে?’
‘কাজ আছে। আমার অনেক কাজ। ’
কলির কণ্ঠে অভিমান, ‘তোমার কাজ তো ঐ টেবিল টেনিস আর ধুমপান। আমি জানি না মনে করেছো?’

কলির এমন অভিমানী কণ্ঠস্বর এর আগে নীরব কখনো শোনেনি। নীরবের কী যে ভালোলাগলো! একদম বড়’পার কণ্ঠস্বর। তারপর একবার চাঁদের দিকে আর একবার মাঠের দিকে আর শেষবার কলির দিকে তাকালো নীরব, ‘বা”চাদের মতো ওরকম ফোঁৎ ফোঁৎ করে কাঁদলে কেন?’
‘তোমার কথায় কান্না এলো যে!’
‘বিশ্বাস করো কলি, তোমাকে সত্যিই পরীর মতো লাগছে। ’
অনেকক্ষণ পর কলি বললো, ‘আ”ছা তুমি কী আমাকে ভালোবাসো? এখনো সময় আছে। বলে ফেলো। ’
‘যদি বলি হ্যাঁ?’
‘তুমি বন্ধুত্বের কাছে পরাজিত হবে। ’
‘দরকার হলে হবো। ’
‘কিন্তু‘ আমি পরাজিত হতে পারবো না। আমার কাছে বন্ধুত্বই বড়। ’

হলে ফিরে ছাদে গিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। তখন পূর্ণিমার চাঁদ মাথার উপর চলে এসেছে। মনের কাছে বার বার জানতে চাই, আমি কী কলিকে ভালোবাসি? স্পষ্ট কোনো উত্তর মেলে না।
আমরা তো প্রায়ই মহুয়াতলায় বসি। দিনে কিংবা সন্ধ্যায় কিংবা রাতে। কিš‘ এর আগে তো কোনোদিন কলিকে নিয়ে আমার এরকম অনুভূতি হয়নি! আজ কলি শাদা সালোয়ার কামিজ-এর সঙ্গে লাল সোয়েটার পরলো আর ওকে মনে হলো পরী! নাকি আমার মনের মধ্যে কিছু একটা তৈরি হ”েছ? তার নাম কী ভালোবাসা? আ”ছা ধরলাম, তার নাম ভালোবাসা। তাই বলে কলি কাঁদবে? আমি কী তাহলে কলির অযোগ্য? বুঝতে পেরেছি, কলি আসলে আমাকে কোনোদিন ভালোবাসবে না। কারণ আমি বাংলায় পড়ি। ও ভালোবাসবে ফার্মেসির কাউকে। কিংবা বিবিএ-এর কাউকে। তাহলে দেখছি আমাদের আফসার স্যারের কথাটাই ঠিক। মেয়েরা ভালোবাসে শিল্প কিন্তু‘ বিয়ে করে শিল্পপতিকে!  

ওকে ফাইন। আমি কাউকে আর সঙ্গ দিতে পারবো না। এতো বন্ধুত্বেরও দরকার নেই আমার।

কিন্তু মুখে যাই বলিনা কেন, মনকে প্রবোধ দিতে পারি না। কলির সঙ্গে আমার তিন বছরের বন্ধুত্ব। এই ক্যাম্পাসে আমরা দুজন মানুষ একে অপরকে সব চেয়ে ভালো বুঝি। এক সঙ্গে ঘুরি, চা খাই, আড্ডা দেই। যেকোনো বিষয় শেয়ার করি। সে কারণে ওর কিংবা আমার ক্লাসমেটরা আমাদেরকে এড়িয়ে চলে। কেননা আমাদের ক্লাসমেটরা ততদিনে জেনে গেছে, আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছি।  
আজ আমার মনটা একেবারে এলোমেলো হয়ে গেছে। কোনো চিন্তাই মাথায় ঢুকছে না। একবার মনে হলো, কলির সঙ্গে আর মিশবো না। আরো মনে হলো, সামনের দিনগুলোতে আমাকে হয়তো আরো বেশি কষ্ট পেতে হবে। সুতরাং আগেই কেটে পড়া ভালো।  
আবার মনে হলো, যদি ওকে সত্যিই আমি ভালোবেসে থাকি, তাহলে তার স্পষ্ট একটা প্রমাণ দরকার। কেননা আমার ভালোবাসাটা কেমন তা আমি জানতে চাই। সেই ভালোবাসার শক্তিটাই বা কেমন তা-ও আমার জানা দরকার।
এসব এলোমেলো চিন্তা-ভাবনা শেষে আমার কাছে একটা কথা স্পষ্ট হলো যে, আপাতত সম্পর্কটা নষ্ট করা যাবে না। তবে যতদিন থাকবে, তা একান্তই আমার স্বার্থে। কারণ আমি নিজেকে যাচাই করতে চাই।

ঘুমানোর আগে এক সময় দীর্ঘপ্রশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মনে হলো, মানুষের জীবনে কখনো কখনো হয়তো এরকম সময় আসে, যখন সে নিজেকেই বুঝতে পারে না।

অনেকেই বলে ছেলেমেয়েতে বন্ধুত্ব হয় না। কথাটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ ক্যাম্পাসের সবাই জানে, নীরব আর আমি একে অপরের ভালো বন্ধু। নীরবকে আমার পছন্দ হয়েছে বলে নিজে যেচে আমি বন্ধুত্বের অফার দিয়েছি। সেই বন্ধুত্ব রক্ষা করার জন্য যা যা করা দরকার আমি করবো। অনেকেই আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে নানারকম রঙ ছড়াতেও চেষ্টা করেছে। আমরা পাত্তা দেইনি। যদি পাত্তা দিতাম, তাহলে এই তিন তিনটা বছর কাটাতে পারতাম না।
একদিন ফার্মেসির মিলা আপু আমার কাছে নীরব সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো। আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম, আমাদের সম্পর্কটা স্রেফ বন্ধুত্ব। এর বেশি কিছু না। মিলা আপু বেশ অবাক হয়েছিলো আমার কথা শুনে। বলেছিলো, ‘এই ক্যাম্পাসে কত বন্ধু দেখলাম। শোনো কলি, ডোন্ট মাইন্ড, বন্ধুত্ব হলে বন্ধুত্ব আর প্রেম হলে প্রেম। ফায়সালা করে নিয়ো। না হলে পরে পস্তাবে!’
সেদিন মিলা আপুর ওপর আমার ভীষণ ঘেন্না আর রাগ হয়েছিলো। সিনিয়র হলে কী হবে, উনাকে মনে হয়েছিলো ছোট মনের একজন মানুষ।
কিš‘ এখন দেখছি আমার অহঙ্কার কমে যাচ্ছে! যাকে নিয়ে আমার এতো অহঙ্কার সে যদি ধসে পড়ে তাহলে আমি কী করতে পারি?
নীরব ভালো ছেলে। কিš‘ ওকে আমি কখনো বন্ধুর বাইরে কল্পনা করিনি। কল্পনা করতেও চাইনা।

তারপর থেকে দুজনের মধ্যে কথা হতো মেপে মেপে। রুটিন মাফিক আড্ডা দেওয়া, চা খাওয়া, রিক্সায় ঘোরাÑএসব আর হয়ে উঠতো না। বিশাল একটা ছন্দপতন। মনে মনে দুজনেই কষ্ট পেতো। কিš‘ কেউ মুখ খুলে কিছু বলতো না।    
একরাতে ফোন আসে কলির। দারোয়ান যথারীতি নীরবকে ডাকে।
নীরব শান্ত কণ্ঠে দারোয়ানকে বলে দেয়, ‘বলেন, রুমে নেই। ’
অগত্যা খুব সকালে কলি চলে আসে নীরবের হল কক্ষে। সেই শাদা সালোয়ার কামিজ আর লাল সোয়েটার পরে। নীরবের ঘুম ভাঙায়। গভীর দৃষ্টি মেলে তাকায় ওর দিকে। দেখে, কদিনেই নীরবের চোখ গর্তে পড়ে গেছে।  
ওদের মধ্যে সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। যা হয়েছিলো, পুরোটাই কলির নির্দেশ। জলদি ফ্রেশ হও, পোশাক চেঞ্জ করোÑএই টাইপের কথা-বার্তা।
নাস্তা সেরে ওরা গিয়ে বসেছিলো মহুয়াতলায়।
ছুটির দিন। সকালের সোনারোদেও শাš‘ মহুয়াতলা।  
সুনসান নিরবতা।

সেভেন ইয়ার্স লেটার
একই জায়গা। একই সময়। সেই পুরাতন চাঁদটা আবার উঠেছে নতুন রূপে। কিš‘ এবার তিনজন মানুষ। গাড়ি থেকে নেমে এলো মহুয়াতলায়। নীরব, কলি আর ওদের ছোট্ট ছেলে নীল।
এবার আর সুনসান নিরবতা নয়। শুধু কথা আর কথা।
সব কথা নীলের কিংবা নীলকে ঘিরে!

কলির অভিমত
পরাজয়ের মধ্যেও থাকে গোপন এক আনন্দ। কখনো কখনো তা বিজয়ের আনন্দের চেয়েও বেশি মধুর!








বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।