ঢাকা, সোমবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

জাদিপাই ফলস

মুনজুরুল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১২
জাদিপাই ফলস

আগের তিনটি পর্বে, আপনারা আমাদের সঙ্গে বান্দবানের এক রোমাঞ্চকর পথে হাঁটতে হাঁটতে কেওক্রাডং এর চুড়া পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এবার আপনাদের একটা বুনো ঝর্ণার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।

সে পথ যেমন দুর্গম আর ঝুকিঁপূর্ণ তেমনি রোমাঞ্চকর।

কেওক্রাডং এর চুড়া বিজয়ের আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই রাত কাটানোর জন্য একটা জায়গার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সন্ধ্যা ৭ টার পর আমরা আবারো হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে আরো প্রায় আধা ঘন্টা। তখন একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। একটা পাহাড়ি গ্রাম পাওয়া গেল। এটা পাসিং পাড়া। এ পাড়ার লোকজন তখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আমাদের জন্য এ পাড়ারই একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা হলো। আর ঐ ঘরের কর্তা (নাম মনে নেই) জুম চালের ভাত আর কুমড়োর তরকারি রান্না করলেন। ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা খাটিয়ার মতো ছিল তাতে দু’জন, বড় একটা চৌকির ওপর ৪ জন আর মাটিতে আরও দুজন এভাবেই সবার থাকার জায়গা হলো ঘরের ভেতর।

মাটিতে বিছানা পেতে যে দুজনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম। খুব ঠান্ডায় ঘুম ভেঙ্গে গেল ভোর বেলা। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে শো শো করে বাতাস ঢুকছিল। ঘরের বাইরে এসে মনে হলো ঘুম ভেঙ্গে ভালোই হয়েছে, না হলে এমন অপরূপ প্রকৃতি দেখা হতো না।

কারণ, ঘরের বাইরে বের হয়েই দেখলাম পুরো পাসিং পাড়া ঢেকে আছে মেঘে। আশপাশের সমস্ত চরাচর যেন একটা মেঘের সমুদ্র। আগের দিন রাত হয়ে যাওয়াতে কেওক্রাডং থেকে নিচের পৃথিবীটা কেমন দেখায় তা বুঝতে পারিনি পুরোপুরি। মেঘে ঢাকা পাসিং পাড়ার ভেতর দিয়ে সেই সকালে আবার উল্টো হাঁটা শুর“ করলাম কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। আবারো আধা ঘণ্টা হেঁটে পৌছলাম কেওক্রাডং। সেখানে বসে সেই নির্মল সকালের বিশুদ্ধ বাতাস কিছুটা নিয়ে নিলাম ফুসফুসে। তারপর আবার যখন পাসিং পাড়ার পৌঁছালাম তখন সকালের খাবার প্রস্তুত। আমাদের সাথের বাঁকিরাও তখন উঠে গেছে। সবার হাতেই ক্যামেরা।   সুর্য্য তখন আশপাশের উচু উচু পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পাসিং পাড়ার উপর উঁকি দিতে শুরু করেছে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত চতুর্দিকে জমে থাকা মেঘগুলো। সেই দৃশ্যই ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। আবারো জুম চালের ভাত, সাথে সেই কুমড়োর তরকারি আর মুরগি দিয়ে সকালের খাবার খেয়ে সকাল সাড়ে ৯ টায় আমরা পাসিং পাড়া ছাড়লাম। এবারের গন্তব্য অনেক দূরে।

ওহ, যেতে যেতে একটা কথা বলি। পাহাড়ে যেসব আদিবাসী লোকজন বসবাস করে তারা কিন্তু একই পাড়ায় বা একই স্থানে সারা জীবন থাকে না। অনেক বছর পর পর তারা জায়গা বদলায়। এক পাড়া বিলুপ্ত হয়, অন্য জায়গায় নতুন আরেক জনবসতি সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। এই যেমন পাসিং পাড়া। পাসিং নামের এক ব্যক্তি বছর পাঁচেক আগে সাথে পাঁচটি পরিবার নিয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন। এই ৫ বছর পর এসে সেখানে পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ তে। আর এই যে কেওক্রাডং এর খুব কাছের জনবসতি এই পাসিং পাড়াকে বিবেচনা করা হয় দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম হিসেবে। কারণ প্রায় ৩২০০ ফিট উচ্চতার কেওক্রাডং এর পরেই প্রায় ৩০৬৫ ফিট উচ্চতায় এই  পাসিং পাড়া। আর বাংলাদেশের অন্য কোন পাহাড়েও এত উঁচুতে কোন জনবসতি নেই। প্রায় সারা  বছরই মেঘের ভেতরেই থাকে এই পাসিং পাড়ার লোকজন। আমরা পাসিং পাড়া ছেড়ে যাচ্ছি, এবার প্রথমেই আমরা যাবো জাদিপাই পাড়ায়। পাসিং পাড়া থেকে রওনা দেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে ওপর থেকে দেখা গেল জাদিপাই পাড়া, অনেক নিচে। সকালের সুর্য্য তার আলোচ্ছটা ছড়ালেও মেঘ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। তার ভেতর দিয়েই আমরা জাদিপাই পাড়ার উদ্দেশ্যে নিচে নামতে শুর“ করলাম। এই নামার পথে পথে পাহাড় চুয়ে নামা পানি গড়িয়ে নামতে নামতে পুরো পথের অনেক অংশকেই বিপদজনকভাবে পিচ্ছিল করে রেখেছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক এমন পথ বেয়ে নামার পর আমরা পৌঁছালাম জাদিপাই পাড়ায়। সেখানে দেখা হলো ৪/৫ জনের একটা দলের সাথে। জাদিপাই ঝর্ণা থেকে মাত্র ফিরে  এসেছে তারা। আগের রাত এই পাড়াতেই থেকে ভোরে তারা গিয়েছিল জাদিপাই ঝর্ণা দেখতে। সে পথে যাবার যে বর্ণনা তারা দিলো তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। সে বর্ণনা যতই আতঙ্ক ছড়াক, আমরা থামিনি। মনোবল এতটাই দৃঢ ছিল আমাদের। শুধু একটা স্যাক্রিফাইস ই করতে হয়েছে। সেটা হলো, মামুনকে রেখে যেতে হয়েছে জাদিপাই পাড়ায়। কারণ, এমনিতেই সে শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে হাঁটতে গিয়ে বার বার পিছিয়ে পড়ছিল। আর তার কারণেই পুরো দলের গতি কমে যাচ্ছিল বার বার। শক্ত মনোবলের কারণে, অনেক কষ্টে উঁচু পাহাড়ে উঠতে পারছিল মামুন কিš‘ তার খুব কষ্ট হচ্ছিল নিচে নামতে।

আবারো নিচে নামা। গত কয়েকদিনে যতটা উপরে উঠেছিলাম ঠিক ততটাই যেন আবার নেমে যাচ্ছি আমরা। নামতে নামতে একটা সময় আবারো পাহাড় জুড়ে জলের বুনো ঝংকার শোনা গেল জঙ্গলের ভেতর। সেটার উৎস আবিস্কার করতে টিপু আর তানিম একটা সময় হারিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতর। তাদের ফিরে আসার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। কিন্তু তাদের ফিরে আসার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তাদের নাম ধরে গলা ছেড়ে জোরে জোরে ডেকেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। শুধু আমাদের ডাক টা তাদের নামের প্রতিধ্বনি তুলে বার বার আমাদের কাছেই ফিরে আসতে লাগলো। তানিম আর টিপুকে খুঁজে বের করতে আমাদের গাইড লাল রুয়াত খুম বম কে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা বাঁকি কয়েকজন আবারো নিচে নামতে শুরু করলাম। তখন নিচ থেকে কাঁধে কিছু একটা চাপিয়ে উঠে আসছিল একজন আদিবাসী। কাছে আসতে দেখা গেল, সজারু শিকার করে ফিরছে, কাঁধে সেই সজারু। পাহাড় থেকে নামার পর একটা ছোট্ট সমতল ভুমির মতো পাওয়া গেল। যেখানে বিন্নি ধান চাষ করেছে জাদিপাই পাড়ার বাসিন্দারা। মাঝখানের সমতলে পাকা বিন্নি ধানের সোনালী আভা, চারদিকে উঠে গেছে উচু উচু পাহাড়, সেসব পাহাড়ের ঢালেও পাকতে থাকা বিন্নি ধান। এসবের মাঝেই জুম ঘর। পুরোটাই যেন একটা ছবি। কেউ একজন বলল, বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড। এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর, টিপু আর তানিম ফিরে এলো। আমরা আবারো হাঁটা শুরু করলাম।

একটা সময় আচানক পথ শেষ হয়ে গেল। খাড়া একটা ঢালের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা। এই খাড়া ঢাল দিয়ে নিচে নেমে যেতে পারলেই পাওয়া যাবে জাদিপাই ঝর্ণা। ভয় পেয়ে থেমে যাওয়ার জন্য এ পথে আসিনি আমরা। নিচে নামা শুরু করলাম। কিন্তু তখন এটা পরিস্কার যে, ভয় আর আতঙ্ক গ্রাস করেছে সবাইকেই। এখানে অন্য কারো চিন্তা করার চেয়ে নিজের টিকে থাকাটাই মুখ্য হয়ে উঠলো। কখনো কখনো কোন কিছু ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে মাটির মধ্যে হাত আর পায়ের আঙ্গুল যতটুকু পারা যায় গেথে দিয়ে পতন থেকে নিজেকে রক্ষা করে করে নামতে লাগলাম সবাই। আর লাল রুয়াত এর কাজ ছিল বড় একটা দা দিয়ে জঙ্গল কেটে কেটে আমাদের জন্য মোটামুটিভাবে পা ফেলার পথ তৈরি করা।

সবকিছুরই একটা শেষ আছে। এই দুর্গম আর চরম ঝুঁকির পথ যখন শেষ হলো তখন আমাদের চোখের সামনে অন্য একটা পৃথিবী। যেন কারো তাড়া খেয়ে দ্রুত পালাচ্ছে এমন গতিতেই উচু পাহাড় থেকে ঝরে পড়ছে এতদিন দেখা কোন ঝর্ণার সাথেই তুলনা চলে না এমন একটা ঝর্ণা। এটাই জাদিপাই ঝর্ণা বা জাদিপাই ফলস। তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসে ভুল করিনি আমরা। আমরা তাহলে দেশের সেই কম এবং সৌভাগ্যবান মানুষদেরই কয়েকজন যারা এত অসাধারণ একটা ঝর্ণা দেখলাম। এই জাদিপাই ঝর্ণার কোথাও কোন কৃত্রিমতা স্পর্শ করেনি। ঝর্ণার শীতল জল যেখানে পড়ছে সেখানে একটা পুকুরের মতো তৈরি হয়েছে। বড় বড় পাথরের ভেতর দিয়ে কল কল করে ফেনা তুলে নাচতে নাচতে ছুটে যাচ্ছে কোন একটা নদীর সাথে মিলবে বলে। খুব সম্ভবত সাঙ্গু নদীর সাথে। এ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার জন্য প্রস্তুত সবাই। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো চায় না  মানুষের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে। কারণ, ক্যামেরা বের করেই আমরা বুঝলাম এখানে ছবি তোলা অনেক কঠিন। কারণ এত উঁচু থেকে এত বড় আকারে ঝর্ণার পানি পড়ছে যে তা আবার ছিটকে ওপরের দিকে উঠে বড় ধরণের একটা জলীয় বলয় তৈরি করেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই শীতল জলে শিক্ত হতে হয়। সেটা না হয় আনন্দের। কিন্তু তাতে ক্যামেরা যে ভিজে যা”িছল! পলাশ আর র“বেল ছবি তোলার একটা বুদ্ধি বের করে ফেললো। পলিথিনের ভেতর ক্যামেরা মুড়িয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে চলে গেল তারা। সেখানে শুয়ে ভিজে ভিজে কয়েকটা ছবি তুলতে পারলো। আর আমি একটু উত্তেজিত আর সাহসী হয়ে কোন আড়লে না গিয়ে সরাসরি ছবি তুলতে গেলেই বিপত্তি হলো। ক্যামেরার লেন্স তো ভিজতে লাগলোই সাথে সাথে এমন একটা পিচ্ছিল পাথরের ওপর পা পড়লো যে সাথে সাথে ধপাস করে পড়ে গেলাম। তখন থেকেই বিগড়ানো শুরু করেলো ক্যামেরা। অবশ্য এক্ষেত্রে আমার আফসোস কিছুটা হলেও কম কারণ, জাহাঙ্গীর ভাই এর লাখোর্ধ দামি ক্যামরাও তার পড়ে যাবার কারণে পানি ঢুকে একইভাবে বিগড়ানো শুরু করলো।

যাই হোক, এক অপরূপ ঝর্ণাদেবী দেখার অতুলনীয় অনুভুতি নিয়ে আমরা আবারো সেই বিপদ সংকুল পথ দিয়ে ওপরে ওঠা শুরু করলাম। এর মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই ওঠার পথ এবারো আরও কর্দমাক্ত, আরও পিচ্ছিল। সবার আগে রুবেল, লাল রুয়াত খুম বম, টিপু, পলাশ, জাহাঙ্গীর, অমিত তারপর আমি। আমার পরে তানিম। উঠতে উঠতে একেবারে শেষ পর্যায়ে তখন। আমার আগের সবাই জীবন বাঁচিয়ে উঠে গেছে ওপরে। আরও মিনিট পাঁচেক উঠতে পারলে আমিও উঠে যাবো উপরে। ঠিক সেই সময়েই ঘটলো বিপদ। আমার পায়ে স্যান্ডেল ছিল। কাদার মধ্যে স্যান্ডেল চেপে ধরে ধরে পা ফেলে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছিলাম। কিš‘ কাদা তখন পায়ের ভেতরে ঢুকে গেছে। হঠাৎ করে স্যান্ডেল স্যান্ডেলের জায়গায় আটকে গেল কিন্তু পিছলে আমার পা বেরিয়ে আসলো স্যান্ডেল ছেড়ে। আরেক পায়ে জোর বাড়ালাম কিন্তু কোন কাজ হলো না। আমি কাদায় পিছলে পড়ে যাচ্ছি নিচে। আশপাশের গাছের লতা-পাতা ধরার চেষ্টাই বৃথা হয়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছি, যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে। পড়ে যাচ্ছি কমপক্ষে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে। ঠিক সেই মুহুর্তে পেছন থেকে সজোরে আমার কোমড়ে চাপ দিয়ে মাটির সাথে আমাকে চেপে ধরলো তানিম। মাটির সাথে আটকে  গেলাম আমি। বেঁচে গেলাম। তারপর অনেকক্ষণ পা নড়তে চায়নি। আহ! জীবন। বেশ কয়েক মিনিট আর পা ফেলার শক্তি খুঁজে পেলাম না। জাদিপাই ঝর্ণা দেখার আনন্দ ভুলিয়ে দিয়েছে সেই পড়ে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি।

বেশ কিছু দিন হয়ে গেল আমরা জাদিপাই ঝর্ণা ঘুরে এসেছি। কিন্তু  প্রকৃতির সেই অপরুপ সৌন্দর্য আজও আমায় ডাকে...

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।