ঢাকা, সোমবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

সংস্কৃতিতে বাংলা নববর্ষ

আরিফুল ইসলাম আরমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১২
সংস্কৃতিতে বাংলা নববর্ষ

পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন, বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়।

ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।

নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষের দিনে সবাই বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং বছরের প্রথম দিনে ভোরে গোসল সেরে পাক পবিত্র হয়। এ দিনে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করা হয়। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি, পিঠা, পায়েসসহ নানারকম  লোকজ খাবার তৈরির ধুম পরে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয় যা শহরাঞ্চলে এখন বহুল প্রচলিত।

নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন  লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন: চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্রময় সমারোহ থাকে মেলায়।   মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থি’তি থাকে। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান সহ বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত, বাউল , মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান ও লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি পরিবেশন করেন। এছাড়া শিশু কিশোরদের আকর্ষণের জন্য বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদির আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশের যেসব স্থানে বৈশাখী মেলা বসে সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছড়িঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়া, মুজিবনগর এলাকা ইত্যাদি। দিনাজপুরের ফুলতলী, রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলীর বৈশাখী  মেলাও বর্তমানে বড় উৎসবে রূপ নিয়েছে।

কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো এবং মুন্সিগঞ্জের গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা এক সময় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের বলীখেলা এবং রাজশাহীর গম্ভীরা প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে নগরজীবনে নগর সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। এদিন সাধারনত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালি পোষাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ দেয়। আর ছেলেরা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে, কেউ কেউ ধুতি পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকালে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা ও নানারকম ভর্তা খাওয়া একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। রমনার বটমুলে  বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলনমেলার সৃষ্টি করে। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান এসো হে বৈশাখ এসো এসো-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়।

নববর্ষ যে ভাবে এলো
খাজনা আদায়ের সুষ্ঠুতা দানের লক্ষে মুঘল সর্মাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার লক্ষে আদেশ দেন। সর্মাটের আদেশে বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজির ওপর আরপিত হয় আদেশ। তিনি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।

মুঘল সর্মাট ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রজাদের ওপর আরোপিত কর আরবী সন হিজরী অনুসারে নেওয়ার প্রথার সাথে সমকালীন বাংলার আবহাওয়ার মিল না থাকায় প্রজাদের ফসল আরবি মাসের সাথে মিলত না এবং প্রজারা তাদের খাজনা বা কর পরিষোধ করতে পারতনা। প্রজাদের অসুবিধার কথা লক্ষ করে মুঘল সর্মাট আকবর বাংলার আবহাওয়ার সাথে কৃষকের ফলমান ফসলের মিল রেখে তৈরি করা হয় ‘ফসলি সন’।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে ফসলি সন গণনা শুরু হয়। এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। পরবর্তীতে এটি প্রকাশ পায় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ হিসেবে। ঐতিহাসিকেরা অনেকেই মনে করেন, বাংলা সন বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল।

আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এটি ছিল আর্তব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল বিষয় ফুঠে উঠত কৃষিকাজ। কৃষকদের ঋতুর ওপরই নির্ভর করতে হতো প্রণিত এই বংলা সনের ওপর।

যুগের বিবর্তন ধারায় নতুন বর্ষ শুরু এবং হিসেবের জটিলতা দূর করতে হালখাতা হয়ে উঠে ব্যবসায়ীদের ও ক্রেতাদের মিটমাটের দিন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।