ঢাকা: গত চার বছর আগে রাজধানীর গুলশান এলাকার আজাদ মসজিদের সামনে ফুটপাতে ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করার সময় অপহৃত এক শিশুকে উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ সময় অপহরণকারী মো. আব্দুল্লাহকে (৩৯) আটক করা হয়।
র্যাব জানায়, আজাদ মসজিদের সামনে ফুটপাতে বেশ কয়েকদিন অনুসরণের পর একদিন বিকেলে ওই শিশুকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে একটি শপিং মলে নিয়ে যান আব্দুল্লাহ। নতুন জামা-কাপড় ও বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দিয়ে সেখান থেকে তাকে নিজের খিলগাঁওয়ের স্টিলের কারখানায় নিয়ে তাকে সাত থেকে আট দিন আটকে রাখা হয়। পরে স্থানীয় এক দালালের কাছে গৃহকর্মী হিসেবে তাকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রির পাঁয়তারা করেন আব্দুল্লাহ। বায়নাপত্রও করা হয়, কিন্তু শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় স্থানীয় দালাল শিশুটিকে কিনতে রাজি হয়নি। পরে আব্দুল্লাহ তাকে বাসায় নিয়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করেন। শিশুটি বাড়ি যেতে চাইলেই তাকে নির্যাতন করতেন আব্দুল্লাহ ও তার স্ত্রী। এভাবে কেটে যায় চার বছর।
অবশেষে ভুক্তভোগী পথশিশুর পরিবারের করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও গোয়েন্দা তথ্যের সহায়তায় অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়।
সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক দরিদ্র দিনমজুরের শিশুকন্যা জীবিকার তাগিদে রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি শুরু করে। প্রতিদিনের মতো ভুক্তভোগী ওই শিশু ফুল বিক্রি করতে ফুটপাতে ও রাস্তায় যেতো। একদিন সে আর বাসায় ফেরেনি। ভুক্তভোগীর বাবা-মা হন্যে হয়ে বিভিন্ন স্থানে তার সন্ধান করতে থাকেন। মেয়ের সন্ধান না পেয়ে পরে গুলশান থানায় মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি করার চার বছরেও কোনো খোঁজ না পেয়ে তারা র্যাব-৩ এ একটি অভিযোগ করেন। পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গুলশান থানায় নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব-৩। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ওই অসহায় শিশুকে উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় অপরহণকারী আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। আব্দুল্লাহ খিলগাঁওয়ের ৯ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাসার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার আব্দুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, মূলত অর্থের লোভে শিশুটিকে চড়ামূল্যে বিক্রির আশায় অপহরণ করেছিলেন। কিন্তু আশানুরূপ মূল্যে বিক্রি করতে না পারায় তাকে নিজ বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে শিশুটিকে নিয়োজিত করে।
ভুক্তভোগী শিশুর জবানবন্দির বরাতে র্যাব কর্মকর্তা আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, জানা যায়, অপহরণের পর আটক থাকাকালীন শিশুটি বাবা ও মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য আব্দুল্লাহর কাছে অনেক মিনতি করলেও তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। যতদিন যায় শিশুটি তার বাবা ও মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়তই কান্নাকাটি করে। এমনকি আব্দুল্লাহর বাসায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করতো তাদের অনেকের কাছেই শিশুটি তার বাবা ও মায়ের বস্তির ঠিকানা দিয়ে সেই ঠিকানায় তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতো। এসব দেখে গ্রেফতার আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী শিশুটিকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখাতেন। যখনই সে তার বাবা ও মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো এ সময় তার ওপর নির্যাতন করা হতো। এভাবেই দুঃখ কষ্টে নির্যাতনের শিকার হয়ে শিশুটির চার বছর কাটিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, গ্রেফতার আব্দুল্লাহ ২০০২ সাল থেকে খিলগাঁও এলাকায় স্টিলের ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করতেন। তার দুই সন্তান (এক ছেলে ও এক মেয়ে) রয়েছে। আব্দুল্লাহ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং এরপর প্রথমে স্টিলের দোকানে কাজ করে সংসার চালাতেন। পরে তিনি একটি স্টিলের কারখানা দিয়ে স্টিলের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন।
তিনি আরও বলেন, উদ্ধার হওয়া শিশু অপহৃত হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর। বর্তমানে তার বয়স ১৬ বছর। সে ১০ বছর বয়স থেকে গুলশানের বিভিন্ন রাস্তায় ও ফুটপাতে ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করে বাবা ও মায়ের অভাব অনটনের সংসারে আর্থিকভাবে সহায়তা করতো। ভুক্তভোগীর বাবা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি রিকশাচালক চালান। ভুক্তভোগীর মা গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কাজ করেন। ভুক্তভোগীর দুই ভাই বোন রয়েছে তারাও রাস্তায় ফুল ও স্টিকার বিক্রি করে।
গ্রেফতার আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাব কর্মকর্তা আরিফ মহিউদ্দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২২
এসজেএ/আরআইএস