ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

মেহেরপুরে উন্মোচিত হচ্ছে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২২
মেহেরপুরে উন্মোচিত হচ্ছে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

মেহেরপুর: ঐতিহাসিক মুজিবনগর খ্যাত মেহেরপুর জেলা এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের রোল মডেল। ভারত সীমান্তবর্তী এই জেলাটি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তেমন উন্নয়ন হয়নি।

 

বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত ১২ বছরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুজিবনগরকে ঘীরে শুরু হয়েছে মেহেরপুর জেলার সার্বিক উন্নয়ন।

বর্তমান সরকার ৮ম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেনের হাত ধরে এখন পাল্টে গেছে মেহেরপুর জেলার সাবির্ক উন্নয়নের চিত্র। জেলায় এখন নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ও কলেজের সুরম্য ভবন, এলাকার নদ-নদী খনন ও জেলাবাসীর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অফিস স্থাপনের মধ্য দিয়ে জেলাকে এখন উন্নয়নের উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে। জেলার যেদিকে তাকানো যাবে সেদিকেই উন্নয়ন দেখা যাবে।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস খ্যাত এই মুজিবনগরকে নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তার অধিকাংশই এখন বাস্তবায়নের পথে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ঐতিহাসিক মুজিবনগরের উন্নয়নে দাবি দাওয়ার দরকার নাই। এখানে কীভাবে উন্নয়ন করতে হবে তা আমরাই করব। সেদিন প্রধানমন্ত্রী মুজিবনগর স্থলবন্দর, দর্শনা থেকে মুজিবনগর রেলপথ, আমঝুপি থেকে মুজিবনগর কেদারগঞ্জ বাইপাস সড়ক নির্মাণ, প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণ ও পঞ্চাশ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, ভৈরব ও কাজলা নদী খনন, মেহেরপুর সরকারি কলেজে মাস্টার্স কোর্স চালু, মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজে পাঁচটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু, মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজকে জাতীয়করণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মুজিবনগর প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই এখন বাস্তবায়নের পথে।

মুজিবনগরের উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় বর্তমান সরকার। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি আধুনিকমানের পর্যটন কেন্দ্র, দৃষ্টিনন্দন লেক, একটি মিনি পার্ক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মিউজিয়াম, সিনেপ্লেক্সসহ আরও অনেক কিছু।

১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি কমপ্লেক্সের অদূরে যে সড়ক দিয়েই ভারত থেকে মুজিবনগরে এসেছিলেন জাতীয় চার নেতাসহ ভারতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। শপথ নিয়ে দেশের প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন, সেই পথটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই সড়কটি (ভার্চ্যুয়ালি) ‘স্বাধীনতা সড়ক’ নামে উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশ অংশে প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০ মিটার রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। চেকপোস্ট বাস্তবায়ন করতে অধিগ্রহণ করা হয়েছে অতিরিক্ত ৩০ একর জমি।

৬৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কুষ্টিয়া (ত্রিমোহনী)-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ (আর-৭৪৫) আঞ্চলিক মহাসড়কের কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনী থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে। যেখানে সাড়ে ৮ কিলোমিটার ফোর লেন রাস্তা তৈরি হবে। ১৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৮ কিলোমিটার মুজিবনগর-দর্শনা অঞ্চলিক সড়কের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের ২৭ আগষ্ট। নির্মাণ করা হয়েছে আমঝুপি থেকে মুজিবনগর কেদারগঞ্জ বাইপাস সড়কটি।

২ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দর্শনা থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত ৫৬ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। রেললাইনের এ রুটে থাকবে ৬টি স্টেশন। মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৪৩৮ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ইউনিয়ন ও গ্রামের বিভিন্ন রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে।

জেলায় এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো অফিস না থাকায় নদ নদী ও জলশায়গুলো ছিল মৃতপ্রায়। জেলায় এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের আঞ্চলিক অফিসের উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া জেলার নদ-নদীগুলো খনন শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৩৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ভৈরব নদের মেহেরপুর জেলায় ৩০ কিলোমিটার ও চুয়াডাঙ্গার অংশে ২৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে নৌবাহিনীর অধীনে ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কাস লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে ৭১ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার ২১৬ টাকায় ভৈরব নদের ২৯ কিলোমিটার খনন কাজ করা হয়। খনন করা হয়েছে সেউটিয়া নদী, স্বরস্বতি খাল।

১০০ শয্যার মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় রূপান্তর করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোর জন্য ২৫০ শয্যা মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের ১১ তলা ভবনের অনুমোদন পায়, এর মধ্যে চার তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলমান রয়েছে কার্যক্রম।

জেলায় স্থাপন করা হয়েছে একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট। ভবণ নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। জেলার মানুষের উচ্চ শিক্ষার দাবি দীর্ঘদিনের। সেই দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০২০ সালে অনুমোদন দিয়েছে মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শুরু হয়েছে মুজিবনগর সহিউদ্দীন টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, মুজিবনগর টিটিসি কেন্দ্র।

এছাড়া মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলায় ৭০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসার সুরম্য ও বহুতল ভবনের কাজ, ২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি মুজিবনগরে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৪ তলা প্রশাসনিক এবং ৫ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক নতুন ভবনের উদ্বোধন করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে জেলায় শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়নে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের বারাদীতে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

বিজিবি ব্যাটালিয়ন মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের উত্তর পাশে সিংএর মাঠে ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।

এছাড়া মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের চাঁদবীল নামক স্থানে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের একটি এফএম রেডিও সেন্টার স্থাপন করতে দেড় একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস।

মেহেরপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) ভবন ও প্রবাসী কল্যান ব্যাংকের উদ্বোধন করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন এমপি।

৫ একর জমির ওপর ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেটর অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার। ২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৭ হাজার ১৩২ টাকা মেহেরপুর জেলা পরিষদ চত্বরে চারতলা বিশিষ্ট রেস্ট হাউস ভবন নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে।

কৃষিনির্ভর মেহেরপুর জেলার উর্বর মাটিতে তিন ফসলি জমি চাষ হয়ে থাকে। জেলায় উৎপাদিত ফসল জেলার চাহিদা মিটিয়ে সারা বাংলাদেশের চাহিদার যোগান দেন এই জেলার কৃষকরা। জেলাকে কৃষি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে জেলার কৃষিকে ঢেলে সাজাতে ইতোমধ্যে অনেকগুলো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই কৃষি সেক্টরের উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুজিবনগর উপজেলায় কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়েছে। এ জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যচারালভাবে ফসল সংরক্ষণ করার জন্য দেশীয় প্রযুক্তিতে গ্রিন হাউজ করতে কৃষকদের দেড় লাখ করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য সংরক্ষণের জন্য নতুন নতুন গোডাউন নির্মাণ করা হবে।

মেহেরপুরের বিভিন্ন উন্নয়ন এখন জেলাবাসীর জন্য উন্মেচিত হচ্ছে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত। রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে সারাদেশের সঙ্গে জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। কৃষি প্রধান এলাকা হওয়ায় কৃষিতে যেমন ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, সেইসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্প্রসারণ ঘটছে। স্বাধীনতা সড়কটি খুললে অনেক পর্যটকও আসবেন ঐতিহাসিক এই দর্শনীয় স্থানে। রেল সংযোগের মাধ্যমে কৃষি ও পর্যটন খাতে আসবে বিপুল পরিবর্তন, ঘটবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। রেল সংযোগের মাধ্যমে কৃষি ও পর্যটন খাতে আসবে বিপুল পরিবর্তন, ঘটবে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।