ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনায় পাবলিক টয়লেটের অভাব!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০২৩
খুলনায় পাবলিক টয়লেটের অভাব!

খুলনা: ৪৫ দশমিক ৬৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের খুলনা মহানগরীতে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) পরিচালিত মাত্র ১৯টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র চার থেকে পাঁচটি ব্যবহার উপযোগী।

যে টয়লেটগুলো রয়েছে সেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং কাঙ্ক্ষিত স্থানেও নয়। যে কারণে অধিকাংশ মানুষ এসব পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করে না। এছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও স্বতন্ত্র প্রবেশপথ না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা এসব পাবলিক টয়লেট এড়িয়ে চলেন।

গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পাবলিক টয়লেট না থাকায় পথযাত্রীরা যত্রতত্র প্রস্রাব করে পরিবেশ নষ্ট করছেন। অনেক এলাকার পথচারীদের নাকে-মুখে রুমাল দিয়ে পথ চলাচল করতে হচ্ছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দ্রুত নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব, আধুনিক, মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের দাবি জানিয়েছে পথচারী ও পরিবেশবাদীরা।

ময়লা পোতা এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট হেলাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে কোনো পাবলিক টয়লেট নেই। বয়স্ক, নারী ও শিশুরা বিড়ম্বনার শিকার হয় চিকিৎসা বা কেনাকাটা করতে বের হলে শহরে হাতের কাছে টিউবয়েল নেই। মানুষের চোখে মুখে ধুলাবালু বা পোকা গেলে পানি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। শহরের মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কার্যালয় থাকলেও সিটি করপোরেশন পাবলিক টয়লেট করতে জায়গা খুঁজে পায় না বলে ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি।

শেখ লুৎফুন্নাহার পলাশী নামের এক চাকরিজীবী নারী বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘর ছেড়ে বাইরে আসি। কয়েক ঘণ্টা পরপর প্রত্যেকেরই প্রাকৃতিক কার্য সম্পাদনের প্রয়োজন পড়ে। শহরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের বড়ই অভাব। যেগুলো রয়েছে সেগুলোও ব্যবহার অনুপযোগী। নারীদের ভোগান্তির পাশাপাশি আমি মনে করি বয়োজ্যষ্ঠরা আরও বিপাকে কেননা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন রকম রোগে রোগাক্রান্ত এমনকি ডায়াবেটিসের শিকার। অনেকের হাতে  সময় সংকটের কারণে সেই মানুষকে বাধ্য হয়ে পথে ঘাটে প্রাকৃতিক কার্য সারতে হচ্ছে তাতে পরিবেশ যেমন দূষণ হচ্ছে তেমনি দৃষ্টিকটু। যেটা নারীদের পক্ষে সম্ভব না। সব কিছু মিলিয়ে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে গণশৌচাগারের একান্ত প্রয়োজন।

সুমাইয়া ইসলাম তুলি নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, খুলনায় যে কয়টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে তার বেশিরভাগ ব্যবহারের অনুপযোগী। একটি মেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে জরুরি প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহার করতে হলেও তাকে বাধ্য হয়ে এক থেকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসায় ফিরতে হয় যা চরমভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। আর কোনো কারণে মার্কেটের কোনো টয়লেট ব্যবহার করতে হলে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়।

খুলনা সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, কেসিসি পরিচালিত গণশৌচারগুলো হলো- শহীদ হাদিস পার্ক,  পশ্চিম ও পূর্ব রূপসা বাসস্ট্যান্ডের ভেতরে, খুলনা ওয়াসা, সোনাডাঙ্গা ট্রাক টার্মিনাল, নতুন রাস্তা মোড়, বিএল কলেজ, জোড়াগেট পাইকারি কাঁচাবাজার, খুলনা রেলস্টেশন, সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, শেখপাড়া বাজার, মিস্ত্রিপাড়া বাজার, বড় বাজার, মাছ বাজার, বয়রা বাজার, রায়েরমহল ক্রিসেন্ট মার্কেট, রুজভেল্ট জেটি সংলগ্ন ও চশমা মার্কেটের পাশের কমিউনিটি টয়লেট।

এসব পাবলিক টয়লেটের মধ্যে বেশির ভাগই অস্বাস্থ্যকর অবস্থার কারণে ব্যবহার অনুপযোগী।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর প্রাণকেন্দ্র রয়্যালের মোড়, শান্তিধামের মোড়, ডাক বাংলোর মোড়, পিকচার প্যালেস মোড়, পিটিআই মোড়, শিব বাড়ি, ময়লাপোতা, নিরালার মোড়, গল্লামারী মোড়ের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে নিউ পাবলিক টয়লেট। সিটি করপোরেশনের যেসব পাবলিক টয়লেট রয়েছে সেগুলোতে দুর্গন্ধ, ভাঙা দরজা, ছিটকিনি না থাকা, ছাদের পানি চুয়ে পড়া, এমনকি নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। ফলে পুরুষরা কোনোমতো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারলেও নারীদের পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। প্রতিবন্ধীদের কথা তো বিবেচনাতেই নেওয়া হয়নি এক্ষেত্রে। বাসা থেকে কাজে বের হয়ে আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রস্রাব-পায়খানা চেপে রাখতে হয় নারী-প্রতিবন্ধীদের।

গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে পাবলিক টয়লেট না থাকায় পুরুষরা লাজলজ্জার মাথা খেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই রাস্তাঘাটের পাশে আশ্রয় নেয়। আবার অনেকে দীর্ঘ সময় প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রাখেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় প্রস্রাব চেপে রাখার ফলে মূত্রনালির সংক্রমণসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন অনেকেই। প্রস্রাবে ইউরিয়া এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের মতো টক্সিন জাতীয় পদার্থ থাকার কারণে বেশিক্ষণ চেপে রাখার ফলে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে কিডনিতে স্টোন বা পাথর তৈরি করতে পারে। এছাড়া প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে ব্লাডার ফুলে যেতে পারে।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের ইউরোলোজিস্ট অ্যান্ড অ্যান্ড্রোলজিস্ট ডা. নিরুপম মন্ডল বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ সময় প্রস্রাব আটকে রাখার কারণে প্রস্রাবের রিদম নষ্ট হয়ে যায়।  কিডনিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে হয়। পায়খানা আটকে রাখলে মূত্রনালির সংক্রমণসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা শহরের অনেকেই জানেন না এ নগরীতে পাবলিক টয়লেট আছে। বাইরে বের হয়ে টাকার বিনিময়ে তিনি পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন।  শহরের বাণিজ্যিক ও জনবসতিপূর্ণ এলাকা লোকজনের সমাগম থাকে বেশি। সেসব এলাকায় পাবলিক টয়লেট না থাকায় পথচারী সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এছাড়া যেসব এলাকায় পাবলিক টয়লেট রয়েছে তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। নগর জীবনে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট থাকলে মানুষের মধ্যে যত্রতত্র মল-মূত্র ত্যাগের সম্ভাবনা কমবে। এতে জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উন্নতি ঘটবে।

তিনি অবিলম্বে নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব, আধুনিক, মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের দাবি জানান।

এদিকে উদ্যোগ ও অর্থ থাকলেও জায়গার অভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

খুলনা সিটি করপোরেশনের কনজারভেন্সি অফিসার মো. আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সিটি করপোরেশন পরিচালিত ১৯টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। হাদিস পার্কের ভেতরের, রেলস্টেশনের ও সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পাবলিক টয়লেট তিনটি আধুনিক মানের। বাকিগুলোর অবস্থা তেমন ভালো না। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পাবলিক টয়লেট তৈরি করার কিন্তু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০২৩
এমআরএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।