ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রাবি শিক্ষক তাহের হত্যা

কনডেম সেলে থাকা দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৪ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২৩
কনডেম সেলে থাকা দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু

রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে যেকোনো দিন রাতেই ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।

এখন ফাঁসি কার্যকরের বিভিন্ন আয়োজন চলছে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে।

বৃহস্পতিবার (২০ জুলাইয়ের) দুপুরে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আবদুল জলিল এ তথ্য জানিয়েছেন।

তবে কারাগারের একটি সূত্র জানিয়েছে, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৫ জুলাই রাতেই ফাঁসি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ফাঁসি রায় কার্যকরে জন্য এরই মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে জল্লাদ ও তার সহকারী কয়েদিদের মধ্যে থেকে চূড়ান্ত জল্লাদ বাছাই করার কাজ চলছে। এছাড়া কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুতের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

কারাবিধি অনুযায়ী কোনো আসামির ফাঁসি কার্যকরের আগে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির জন্য নির্ধারিত মঞ্চ প্রস্তত করেন। সেখানে আসামির ওজনের তিনগুণ বস্তু তুলে ফাঁসি কার্যকরের ট্রায়াল দেওয়া হয়। আসামিদের তওবা পড়ানোর জন্য ইমাম নির্ধারণ ছাড়াও আসামিদের শেষ ইচ্ছে পূরণের ব্যবস্থা করতে হয়। ফাঁসি কার্যকরের একদিন বা কয়েক ঘণ্টা আগে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করানোর বিধান রয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ এখন সেসব প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৫ জুলাই রাতেই দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হতে পারে। কারাবিধি অনুযায়ী স্বজনদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের পরই ফাঁসির ক্ষণ গণনা শুরু হবে।

তবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আবদুল জলিল বলেন, এখনও কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি বলেন, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই যেকোনো দিন কারাবিধি অনুযায়ী দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

এদিকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার পর থেকে রাজশাহী কারাগারে বন্দি প্রধান আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের পক্ষ থেকে কোনো তৎপরতা না থাকলেও অপর আসামি জাহাঙ্গীরের ফাঁসি স্থগিত চেয়ে একের পর এক নানা কৌশল অবলম্বন করছে তার পরিবার।

এর আগে গত ১০ জুলাই জাহাঙ্গীরের ফাঁসি স্থগিত চেয়ে উচ্চাদালতে ফের রিট পিটিশন করা হয়। কিন্তু উত্থাপিত হয়নি মর্মে সেই পিটিশন খারিজ করে দেওয়া হয়। মন্তব্যে আদালত জানান, আপিল বিভাগের রায়ে হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যেখানে আপিল বিভাগ বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন সেখানে পুনরায় একই বিষয়ে রিট এনে আসামিদের ফাঁসি কার্যকরে কারা কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ গ্রহণে বাধা দেওয়া আদালতের রায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন বলেই মনে করি। ’

এদিকে উচ্চাদালত থেকে ফিরেয়ে দেওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি স্থগিত চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে এবার চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এতে ন্যায়বিচার চেয়েছে পরিবার। আগামী ২৩ জুলাই সেটি আদালতে উত্থাপন হওয়ার কথা আছে।

এছাড়া অধ্যাপক ড. তাহের হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি জাহাঙ্গীর আলমের রায় স্থগিতের জন্য তার পরিবার সর্বশেষ মার্কিন দূতাবাসেরও দ্বারস্থ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই মিজানুর রহমান গত রোববার (১৬ জুলাই) মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে আবেদন ও মামলার নথিপত্র জমা দিয়েছেন।

মার্কিন দূতাবাসের কাছে তারা অভিযোগ করেছেন, এ মামলায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ড. মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম। তাই ফাঁসির রায় স্থগিতে মার্কিন দূতাবাসের হস্তক্ষেপ চান তারা। তবে দূতাবাস থেকে এখনও কোনো সাড়া মেলেনি। এরপরও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মিজানুর রহমান আশা করছেন, দূতাবাস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলবে।

ফাঁসির আসামি জাহাঙ্গীরের আইনজীবী এস এন গোস্বামী জানিয়েছেন, ফাঁসির রায় কার্যকরের আগের সব ধাপ শেষ হওয়ার পর জাহাঙ্গীরের ভাই সোহরাব হোসেন উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছিলেন। তবে গত সোমবার রিটটি খারিজ করে দিয়েছেন বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার বেঞ্চ। তারপর স্বজনরা চেম্বার জজ আদালতে গেছেন। সেখানে মামলার প্রয়োজনীয় নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে।

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। পরদিন বাড়ির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় ড. এস তাহেরের মরদেহ।  
এরপর রাবি অধ্যাপক তাহেরের করা একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) সূত্র ধরে একই বিভাগের শিক্ষক মিয়া মো. মহিউদ্দিন ও রাবি ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তার বাড়ির কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজন আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক ড. এস তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মো. মহিউদ্দিন এ হত্যার পরিকল্পনা করেন। বালিশচাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ বাড়ির পেছনে নেওয়া হয়। মরদেহ গুমের জন্য জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ড. তাহেরের মরদেহ ফেলা হয়।

২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহেরের মরদেহ। এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় পুলিশ।

চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন।

দণ্ডিতরা হলেন- রাবি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. এস তাহেরের বাড়ির সেই কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সমন্ধি আব্দুস সালাম।

খালাসপ্রাপ্ত চার্জশিটভুক্ত দুই আসামি হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী।  

২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন হাইকোর্ট।

এরপর আবারও রিভিউ আবেদন করেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি। তবে এ বছরের ২ মার্চ রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুজনের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।

নিম্ন আদালতে দুজনের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় এসেছিল তাই বহাল থাকে আপিল বিভাগে, খারিজ হয় রিভিউ আবেদনও।

এজন্য প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না তাদের কাছে। তবে এরপরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দণ্ডিত এ দুজনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু উত্থাপিত হয়নি মর্মে পরে সেই আবেদনও খারিজ করে দেন বিচারপতি মো. জাফর আহমেদ ও মো. বশির উল্ল্যার হাইকোর্ট বেঞ্চ। মূলত এর পরই কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে এ ঘটনায় দোষ স্বীকার করে নিজেদের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জানান। তবে রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০০১ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২৩
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।