সুন্দরবন সংলগ্ন পশ্চিম খেজুরিয়া গ্রাম থেকে ফিরে: সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপের খেজুরিয়া গ্রামে অভাবী পরিবারে জন্ম দেবেন মণ্ডলের (৬৭)। লেখাপড়া শেখা হয়নি।
সুন্দরবন যেমন সুন্দর তেমনি এর বাঁকে বাঁকে ওঁৎ পেতে থাকে নানা বিপদ। আছে বাঘ নামের এক ভয়ঙ্কর সুন্দরের ভয়, যার সামনে পড়ে গেলে আর ঘরে ফেরা হয় না কারো। কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে সেই বাঘের আক্রমণের শিকার হন দেবেন মণ্ডল। তবে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে প্রাণে বেঁচে ফেরেন তিনি।
সম্প্রতি বাংলানিউজের কাছে বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসা সেই গল্প বর্ণনা করেন তিনি।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ২০১১ সালে আমি ৫ জন জেলে নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গেছিলাম। কিছু মাছ ধরার পর রান্নার কাঠ কাটতে বনে উঠেছিলাম। ৫ জন লোক হওয়ায় আমি বাকিদের কাঠ কাটতে বলে ঘুরে আসতে যাই। আমি ঘুরে এসে দেখি ওরা কাঠ প্রায় কেটে ফেলেছে। ওরা বলে আরও কিছু গাছ আছে এগুলো শেষ করে সেগুলো কাটবো। তুমি শুকনো গাছগুলোর গোড়া কাটতে লাগো, আমরা এগুলো গোছাই। আমি যখন গাছের গোড়ায় গিয়ে কোপ দেবো এমন সময় দেখি বাঘ শূণ্য থেকে ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে এসে আমার বাম গাল ও কপালে থাবা বসিয়ে দিল। আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাব বলে বাঘের গলা জড়িয়ে ধরি। এ ঘটনা ঘটে পৌষ মাসের ৬ তারিখ তখন সারা দিন কুয়াশা থাকতো। এসময় আমার সাথে থাকা অন্যরা ভয়ে কেউ নৌকার দিকে যায়, কেউ গাছে ওঠে। আমার কাছে কেউ ছিল না। আমি তখন কাউকে ডাকতেও পারছি না। বাঘ আমার কপাল থেকে খামচে নিচের দিকে আসছে। তখন চোখের কোনার মাংস ঝুলে যায়। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। একটু পর বাঘ আমাকে ভুট করে ফেলে দেয়। ঘাড়ে ৩টা কামড় বসায়। এখনও দাগ আছে। বাঘ চিন্তা করছে ঘাড়ে কামড় দিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। গলায় মাফলার জড়ানো ছিল তার ওপর থেকে কামড় দেওয়ায় বাঘ নিয়ে যেতে পারছিল না।
তিনি বলেন, এ সময় আমার সাথে যে ৫ জন ছিল তাদের মধ্যে একজন আমার দিকে খেয়াল করে দেখে বাঘ আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তখন সে নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে একটা লাঠি দিয়ে বাঘের মাথায় আঘাত করে। মাথায় বাড়ি দেওয়ার সাথে সাথে বাঘ আমাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড় দেয়। তখন ও সবাইকে ডাকতে শুরু করে। বলে দ্রুত এসে লাশ ধরে নৌকায় তোল। ওরা যখন আমাকে ধরে ওঠায় তখন আমি বলি, আমি মরিনি আমাকে উঠিয়ে নৌকায় নে। এ কথা বললে একজন বলে, দাদা আপনার ঘাড়ের একটি শিরা দিয়ে রক্ত এমনভাবে পড়ছে যে ৪-৫ হাত দূরে গিয়ে পড়ছে, এখন কি করবো। আমি বলি আমার হাতে একটু মাটি দে। মাটি দিলে আমি ঘাড়ে লাগালে রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু নাড়া লাগলেই আবার রক্ত বের হতে থাকে। তখন আমি বলি কাপড় চোপড় চেপে ধরে নৌকায় নে। নৌকায় নেওয়ার পর ওরা আমাকে শুয়ে দিতে চায় কিন্তু আমি বলি শুয়ে দিলে রক্ত পড়ে গিয়ে আমি মারা যাবো। যে কেউ আমাকে নিয়ে বসে থাকতে হবে। কাপড় দিয়ে চেপে রাখতে হবে। এরপর নৌকা তো দুটো। একটি নৌকায় মামলামাল সব গুছিয়ে রেখে অন্যটি নিয়ে আমার চলে আসি। আমাদের ঢাংমারী নিয়ে এসে নৌকা রেখে স্থানীয় চিকিৎসক অশোক বাবুকে নিয়ে আসতে যায় আমার সাথে থাকা লোকজন। ডাক্তার প্রথম দেখেই বলে আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মোংলা কিংবা খুলনায় নিয়ে যান। এ সময় লোকজন আমাকে উঠিয়ে ওয়াপদার বেঁড়ি বাঁধে রেখেছে। আমি তখন ডাক্তারকে বলি কাকা আপনি চিকিৎসা করেন তা না হলে আমি মরে যাব কিন্তু মোংলা বা খুলনা যাবো না। তখন আমাকে ডাক্তার সেলাই দেয়। স্থানীয় রুহুল মেম্বারের বাড়িতে রেখে ১৭ দিন আমাকে স্যালাইন দেওয়া হয়। এ কয়দিন মুখে কোনো খাবার দেয়নি। পরে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ৩ মাসের মধ্যে আমি সুস্থ হয়ে যাই। সুস্থ হওয়ার পর মুখ বাকা থাকায় আমি ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম। ওখানে ২ মাস ৬ দিন ছিলাম। সুন্দরবনে আমার মাছ ধরার পাস ছিল। কিন্তু তারপরও আমি সরকারি বা বেসরকারি কোন সহযোগিতা পাইনি। কাগজপত্র নিয়েছে অনেকেই কিন্তু কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি।
দেবেন মণ্ডলের পাশের গ্রাম পশ্চিম ঢাংগারীর বাসিন্দা সন্দোষ ঘরামী জানান, সুন্দরবন ও সুন্দরবন উপকূলীয় নদীতে মাছ ধরেই সংসার চলতো দেবেন মণ্ডলের। বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। সেই থেকে অনেকটা শারিরীকভাবে দুর্বল। তারপরও ভূমিহীন দেবেন মণ্ডল কৃষিকাজ, দিন মজুরীর ভিত্তিতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। ছেলেকে শিখিয়েছেন লেখাপড়া। অভাব অনটনের কারণে এখনও মাঝে মাঝে তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে যেতে হয়। ছেলের একটা চাকরি হলে হয়তো বা কিছুটা সুখের মুখ দেখবেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২৩
এমআরএম