ঢাকা, শনিবার, ৮ ভাদ্র ১৪৩১, ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১৮ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

মাছ ধরার ফাঁকে বানান শিল্পকর্ম, উপকূলে জাদুঘর করার স্বপ্ন জাকিরের

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৩
মাছ ধরার ফাঁকে বানান শিল্পকর্ম, উপকূলে জাদুঘর করার স্বপ্ন জাকিরের

পাথরঘাটা (বরগুনা): সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদঘেষা রুহিতা গ্রাম। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ জাকির হোসেন মুন্সি।

পূর্বপুরুষেরা জেলে পেশায় ছিলেন। পরম্পরায় তিনিও মাছ শিকার করেন। তবে ফাঁকে ফাঁকে দিনমজুরের কাজও করেন। জীবিকার যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করলেও জাকিরের আছে এক শিল্পীসত্তা।

সংসারের কাজ শেষে সময় পেলে এই শিল্পীসত্তার কাছে নিজেকে সঁপে দেন তিনি। নদী ও খালপাড় থেকে পরিত্যক্ত কাঠ ও শ্বাসমূল তুলে এনে খোদাই করে বানান বিভিন্ন রকমের শিল্পকর্ম। সৃষ্টি করেন উড়োজাহাজ, ট্রলার, নৌকা, হরিণ, মাছসহ নানা আকৃতির শিল্পকর্ম।

এই শিল্পকর্মে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন জাকির। তার এসব কারুকাজে বেজায় খুশি এলাকার মানুষও। তাদেরই উৎসাহে জাকিরের শিল্পকর্ম তৈরির কাজ পাচ্ছে আরও গতি। এই দরিদ্র জেলে এখন পিছিয়ে থাকা উপকূলে জাদুঘর তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।

এলাকাবাসী বলছেন, সংসার টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চললেও জাকির শিল্পচর্চা থেকে পিছপা হননি। নিভৃত পল্লিতে তার এসব শিল্পকর্ম সব শ্রেণির মানুষকেই মুগ্ধ করছে। অনেকে দূর-দুরান্ত থেকে দেখতে আসছেন জাকিরের এসব শিল্পকর্ম।

জাকির হোসেন মুন্সির বয়স ৫৪ বছর। তার বাবার নাম মরহুম আ. রশিদ মুন্সি। বরগুনার পাথরঘাটার সদর পাথরঘাটা ইউনিয়নের রুহিতা গ্রামের বাসিন্দা জাকির পর্যটনপ্রেমী ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী। তিনি এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক সাপ উদ্ধার করেছেন। সাপ উদ্ধারসহ বন সংরক্ষণে ভূমিকা রাখায় তিনি এলাকায় পরিচিত ‘টাইগার জাকির’ হিসেবে।  

কথা হচ্ছিল জাকির হোসেন মুন্সির সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘গরিবের সংসারে জন্ম নেওয়ায় লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে মাছ ধরার কাজ করেছি। মাছ শিকারের পাশাপাশি বন এবং বন্যপ্রাণীর প্রতি প্রেম ছিল। বন ধ্বংস ও বন্যপ্রাণী হত্যা সহ্য করতে পারতাম না। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় বাসিন্দা মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ, আরিফুর রহমান ও শফিকুল ইসলাম খোকনের সঙ্গে কাজ করছি। ’

তিনি বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে বনের মধ্যে প্রায়ই থাকতে হয়। বনে শ্বাসমূল দেখে সেটা ভালো লাগায় তুলে এনে খোদাইয়ের কাজ শুরু করি। এছাড়া বন থেকে পরিত্যক্ত কাঠ সংগ্রহ করে সেগুলো ডিজাইন করে চারুকলার মতো সাজিয়ে রেখেছি। এগুলো দিয়ে বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় কিছু, যেমন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ, স্পিড বোট, জাতীয় পতাকা, উড়োজাহাজ, ট্রলার, নৌকা, হরিণ, মাছসহ নানা আকৃতির শিল্পকর্ম বানিয়েছি। ’

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এই শিল্পকর্ম তৈরি করছেন জানিয়ে জাকির বলেন, ‘দুই বছর আগে ২২ হাজার টাকায় আমার কিছু শিল্পকর্ম বিক্রি করেছি। অনেক স্বপ্ন ছিল আমি অনেক বড় কিছু হবো। ভাগ্য খারাপ, জেলে ছাড়া আর কিছুই হতে পারিনি। আমি সব সময় আলাদা কিছু নিয়ে ভাবি। একদিন নদীতে মাছ শিকারের জন্য যাই, তখন আমার মনে হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো, গাছের শিকড় দিয়ে কিছু তৈরি করা যায় কি না। পরে সেই চেষ্টাকে কাজে লাগাই। এর সঙ্গে বিভিন্ন রকমের জিনিস, কাঠ খোদাই করেও তৈরি করেছি। আমি চাই আমার এখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে শিল্পকর্ম যেগুলো রয়েছে এগুলো নেওয়া হোক। মানুষ দেখুক উপকূলের মানুষও চেষ্টা করলে কিছু একটা বানাতে পারে। ’

পনু চাপরাশি, ইসমাইল, আ. মন্নানসহ স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জাকিরের কাজ তাদের খুব ভালো লাগে। এসব কাজ যদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে জাকির আরও এগিয়ে যাবেন। পাশাপাশি এলাকাবাসীও খুশি হবে।

প্রবীণ সাংবাদিক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জাকির হোসেন অত্যন্ত গরিব মানুষ। মাছ শিকার ও দিনমজুরি করে কোনোভাবে দিনযাপন করছেন। এর মধ্যেও জাকিরের প্রতিভার বিকাশ ঘটছে, অনেক আকর্ষণীয় শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। তাকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জরুরি। ’

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, ‘জাকিরের প্রতি আমাদের সুদৃষ্টি রয়েছে। আমরা সার্বিক সহযোগিতা করবো। পাশাপাশি সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৩
এইচএ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।