ঢাকা, শনিবার, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ০১ মার্চ ২০২৫, ০০ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

আজ রেল দিবস

‘রুগ্ন’ রেলে নবদিগন্ত

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৩
‘রুগ্ন’ রেলে নবদিগন্ত কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: যোগাযোগের প্রাচীন মাধ্যম রেল। স্বাচ্ছন্দ্যে আরামদায়ক যাত্রায় আগ্রহী যাত্রীরা ভ্রমণের জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী এই রেলকেই বেছে নেন।

উন্নতবিশ্বে রেলসেবা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল বছরের পর বছর। তবে সেই পিছিয়ে থাকার গল্প এখন ‘অতীত’। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যে, রেলের নবজাগরণ ঘটেছে। যোগাযোগের এই মাধ্যম এখন কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় আটকে নেই। সরকারের মেগা প্রকল্পের ফলে এই রেল এখন মানুষকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের গন্তব্যে। উন্মুক্ত করেছে চট্টগ্রাম পেরিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের নগরী কক্সবাজারে যাওয়ার পথ। রেলেই এক সুতোয় গেঁথে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণের জনপদ।

বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে জানা যায়, ১৯৯২-১৯৯৩ সালে রেলের সাড়ে ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবসরে পাঠানো হয়। ওই সিদ্ধান্তের পর পুরো রেল ব্যবস্থা যেন হোঁচট খায়। রেলওয়ে পরিণত হতে থাকে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে, সেবার মান হতে থাকে নিম্নমুখী।
 
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণাধীন যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল সংযোগ তৈরি করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলস্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের কাজও শুরু করেন। রেলে আশার সঞ্চার হতে থাকে।  

তবে ২০০১ সালে সরকার পরিচালনায় পালাবদল হলে ফের ধাক্কা খায় রেল। সিলেট, খুলনা, লালমনিরহাট সেকশনের অনেক রেলরুট বন্ধ হতে থাকে। বন্ধ হতে শুরু করে অনেক লোকাল ও মেইল ট্রেন।  

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে ফের রেলের প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। একের পর এক মেগা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

এর মধ্যে রয়েছে—ঢাকা-চট্টগ্রামের ডাবল রেলপথ নির্মাণ, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্প, কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ, ঢাকা-টঙ্গী চার লেন রেলপথ নির্মাণ, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া সরাসরি রেলপথ নির্মাণসহ ছোটবড় ৫০টির বেশি প্রকল্প। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা।

এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে খুলনা-মোংলা রেলপথ, কক্সবাজার রেলপথ, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন রেলপথ প্রকল্প। আংশিক উদ্বোধন হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ও টঙ্গী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন রেলপথ প্রকল্প।  

রেলের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, চালু হওয়া এসব রেলপথ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। মানুষের যোগাযোগ যেমন আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হয়েছে, তেমনি পণ্য পরিবহনও হয়েছে সহজ।

বিশ্ব ইতিহাসে যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারণা বদলে দিয়েছিল রেলের আবিষ্কার। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জর্জ স্টিফেনসন ১৮২৫ সালে ব্রিটেনে রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাত বছর পরেই ভারতবর্ষের মাদ্রাজে ১৮৩২ সালে রেলপথ চালু হয়। আর বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ব্রিটিশদের হাত ধরে রেলপথ চালু হয় ১৮৬১ সালে। দর্শনা-জগতি রুটের মাধ্যমে চালু রেলপথ ব্রিটিশদের হাত ধরে পরবর্তী ৯০ বছরেই বাংলার অধিকাংশ জেলাতেই পৌঁছে যায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রেল যোগাযোগের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হার্ডিঞ্জ ব্রিজসহ ছোট-বড় শতাধিক রেলসেতু ধ্বংসের মুখে পড়ে। দেশ স্বাধীনের পরে অতিদ্রুতই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেলওয়ে ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হন। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে থমকে যায় বাংলাদেশের রেলওয়ের উন্নয়ন। বন্ধ হয়ে যায় নতুন রেলপথ নির্মাণ ও রেলওয়ে খাতে বিনিয়োগ।  

ছবি: সংগৃহীতএ প্রসঙ্গে গত ১১ নভেম্বর কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরশাসকরা এ দেশের কোনো মঙ্গল বা উন্নতি চায়নি। যার কারণে সাধারণ মানুষের যাত্রী পরিবহনের যে কয়টা মাধ্যম ছিল, একে একে তা ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এমনকি রেল লাভজনক নয়, এ অজুহাত তুলে রেলকে বন্ধ করে দেওয়ারও অপচেষ্টা চালানো হয়। রেলের লোকবল গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, অনেক রেললাইনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, তখনই এটা করা হয়।

ওই অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তের কারণেই রেলওয়ে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। না হলে রেল আজ ধ্বংস হয়ে যেতো।

২০৩০ সালে রেলে নবদিগন্ত
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার গত ১৪ বছরে সারাদেশের নতুন রেলপথ নির্মাণ করেছে ৭৪০ কিলোমিটার। আর সিঙ্গেলগেজ রেলপথ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে আরও ২৮০ কিলোমিটার।

অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ক্ষয়প্রাপ্ত রেলপথ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে এক হাজার ৩০৮ কিলোমিটার। আর নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ১২৬টি এবং স্টেশন ভবন পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ২২৩টি। গত ১৪ বছরে নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে ৭৩২টি, আর রেলসেতু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ৭৭৪টি।

পরিবর্তন এসেছে যাত্রী পরিবহন সক্ষমতায়ও। ট্রেনে গত ১৪ বছরে লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন) যুক্ত হয়েছে ১১১টি। অন্যদিকে যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হয়েছে ৫৮৮টি। নতুন করে ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হবে ৪৬০টি, আর মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হবে ১৫০টি। যুক্ত হবে আরও ৪৬টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ।

পণ্য বহনের জন্য ওয়াগন যুক্ত হয়েছে ৫১৬টি। আর নতুন ওয়াগন যুক্ত হবে এক হাজার ৩১০টি। আধুনিক লাগেজ ভ্যান যুক্ত হবে ১২৫টি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন চালু হয়েছে ৭২৩টি।

২০৩০ সালের মধ্যে দেশ ভিন্ন রেল যোগাযোগের সাক্ষী হবে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সরকার নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ করছে। এতে সারাদেশে রেল যোগাযোগের দারুণ নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। রেলখাতে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় নবদিগন্তের সূচনা হবে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে রেলওয়ের পরিসেবায়।

রেলের বাজেট বাড়াতে পৃথক মন্ত্রণালয়
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলে বরাদ্দের ৯০ শতাংশই পেত সড়ক বিভাগ। আর যে ১০ শতাংশ রেল পেত তা চলে যেত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে। ফলে রেলওয়ে নিতে পারত না নতুন কোনো রেলপথ নির্মাণ বা সংস্কারের উদ্যোগ।  

এই অবস্থায় ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।  

প্রসঙ্গটি টেনে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলওয়েতে নতুন কোনো নিয়োগ ছিল না এবং এটাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে যোগাযোগব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ছিল রেল। রেলকে বেসরকারিকরণের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছিল। এরপর গত ১৪ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে একের পর এক মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের নব দিগন্তের সূচনা হয়।

৬৪ জেলায় রেলপথ নিতে মহাপরিকল্পনা
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে এতদিন ৪৩টি জেলায় রেলপথ চালু ছিল। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধনের মাধ্যমে আরও তিন জেলা যুক্ত হয় দেশের রেল নেটওয়ার্কে। এ তিন জেলা হলো- মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর।  

চলতি নভেম্বর মাসে উদ্বোধন হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের আরও দুই প্রকল্প। খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্প। এর মাধ্যমে বাগেরহাট ও কক্সবাজার রেলপথ চালু হওয়ায় দেশের ৪৮ জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণ হয়েছে।

আর ২০২৪ সালে পদ্মা রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের উদ্বোধন হলে যুক্ত হবে নড়াইল। আর মধুখালী-মাগুরা রেলপথের উদ্বোধন হলে নতুন করে যুক্ত হবে মাগুরা জেলা।  

তারপর ধীরে ধীরে রেলওয়ের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে যুক্ত হবে বাকি জেলাসমূহ। এসব জেলাকে রেলপথে সংযুক্ত করতে বিভিন্ন প্রকল্পের সমীক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এর মধ্যে প্রথম ধাপে সাতক্ষীরা, বরিশাল, রাঙামাটি, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মেহেরপুর রেলপথের আওতায় আসবে। আর ২০৪৫ সালের মধ্যে সর্বশেষ ধাপে লক্ষ্মীপুর, শেরপুর, মানিকগঞ্জ, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা রেল সংযোগে যুক্ত হবে।

রেলকে প্রত্যেকটি জেলার সঙ্গে সম্প্রসারিত করা হবে জানিয়ে নূরুল ইসলাম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আমাদের রেলকে প্রত্যেকটি জেলার সঙ্গে সম্প্রসারিত করব। আমাদের পোর্টগুলোতে (বন্দর) সম্প্রসারিত করব। আমাদের রেলগুলোকে ইলেকট্রনিক ট্রেকশালে রূপান্তরিত করব। আমাদের যে সিঙ্গেল লাইন আছে সেগুলো ধীরে ধীরে ডাবল লাইনে রূপান্তর করব।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৩
এনবি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।