ঢাকা: চলতি বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এর পেছনে দেশের ছাত্র-জনতা যেমন ভূমিকা রেখেছিলেন, তেমনি একঝাঁক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক ও কনটেন্ট ক্রিকেটাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইন ও গণমাধ্যমে টকশোতে অংশ নিয়ে সরকারের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন তারা। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থেকেছেন এসব প্রবাসী। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে এসব সাংবাদিকের অনেকেই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে আসতে পারেননি। কারও বাড়িঘরও দখল হয়ে গেছে। কিন্তু স্বৈরাচার সরকারের হুমকি-ধামকি, রোষানল তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। দেশের সরকার পরিবর্তন হলো কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও তারা বিভিন্ন মামলার আসামি। তারা দেশের বর্তমান সরকারের কাছে পাচ্ছেন না কোনো স্বীকৃতি।
অলিউল্লাহ নোমান : টানা ১২ বছর লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান। আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতিত এই সাংবাদিক জানান সেসব নির্যাতন আর দেশত্যাগের কথা। তিনি বলেন, সেটি ছিল ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাস। কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ সাজিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র এক রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা নিজামুল হক নাসিম এবং তার বন্ধু আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন আমার হাতে আসে। এই কথোপকথন পাওয়া গিয়েছিল নভেম্বরের শুরুর দিকে। ১৭ ঘণ্টার কথোপকথন ছিল রেকর্ডে। সম্পাদক মহোদয়ের কাছে কথোপকথনের রেকর্ড দিয়েছিলাম অনুমোদন করার জন্য।
ডিসেম্বরে আমার দেশ সম্পাদক মজলুম মাহমুদুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন কথোপকথন প্রকাশ করবেন। এর আগে তিনি নিজে শুনেছেন এবং আমার জন্য গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছেন।
৯ ডিসেম্বর আমার দেশ প্রথম কিস্তি প্রকাশ করেছিল। টানা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশের পর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আরেক নেতা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক হাই কোর্ট বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করেন। ১৩ ডিসেম্বর জারি করা এ নির্দেশনায় স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আমার দেশের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের আসনে থাকা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ১৩ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকেও একজন প্রসিকিউটর আমার দেশ সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন। স্কাইপ কথোপকথনে মূলত উঠে এসেছিল ট্রাইব্যুনাল কীভাবে সাজানো হয়েছে। বিচারের রায় কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে। বেলজিয়াম থেকে আহমদ জিয়াউদ্দিন রায়ের স্ট্রাকচার লিখে দিচ্ছেন। চার্জ গঠনের আদেশগুলো কীভাবে বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানো হয়েছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যার মূল চক্রান্তের সব তথ্য উঠে আসে তাদের দুজনের কথোপকথনে। এতে ট্রাইব্যুনালের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায় এবং বিচারের নামে প্রহসনের চিত্র সাধারণ মানুষের সামনে চলে আসে। এই কথোপকথন নিয়ে তখন সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এ অবস্থায় সম্পাদক মহোদয় এবং আমি অফিসেই অবস্থান করতাম। একরকম অফিসবন্দি বলা চলে। ১৭ ডিসেম্বর দুপুরের পর হঠাৎ করেই সম্পাদক মহোদয় ডেকে আমাকে বললেন, জরুরি কাজে লন্ডনে যেতে হবে। কবে যেতে হবে জানতে চাইলাম। বললেন, আজকেই। আমি রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করলাম। অনেক কাকুতি-মিনতি করলাম একদিন পরে যাই। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলতে থাকলেন আজই যেতে হবে। এ অবস্থায় বিকালেই অফিস থেকে রওনা হই। অজানা আশঙ্কায় অফিস থেকে বের হয়েছিলাম। টানা ১২ বছর লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছি। স্কাইপ কথোপকথনে একটি বাক্য মিথ্যা বা অসত্য ছিল এটা কেউ বলতে পারেনি। নিজামুল হক নাসিম এখনও বেঁচে আছেন। তাকে ট্রাইব্যুনাল থেকে সরানো হলেও পরবর্তীতে আপিল বিভাগে নিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনো অস্বীকার করেননি স্কাইপ কথোপকথনের বিষয়টি।
পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলাম, গুম-অথবা বিচারবহির্ভূত নির্যাতনের আশঙ্কা থেকেই সম্পাদক মহোদয় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। লন্ডনে পৌঁছার পর সম্পাদক মহোদয় বলেছিলেন, আমি এখন নিশ্চিত। আমার যা হয় হোক। তোমাকে অন্তত রক্ষা করতে পেরেছি।
এম রহমান মাসুম একজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। বাংলাদেশে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের কঠোর সমালোচনা করে তিনিই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনার ঝড় তোলেন। ইউটিউব-ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠান শুরু করেন সেই ২০১২ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, ইউরোপিয়ান মেম্বার অব পার্লামেন্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের তার অনুষ্ঠানে যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায় কার্যক্রম ও একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরা অব্যাহত রাখেন। তার বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে মানুষ দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারত। এ ছাড়া তিনি প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রবাসীদের অধিকার আদায়ে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের দুর্দশা ও তাদের অধিকার নিয়ে প্রতিবাদ ও কাজ শুরু করেন। যিনি সরেজমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তাদের অবস্থা দেখে আসেন এবং একই প্ল্যাটফরমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য রেমিট্যান্স ফাইটার্স অব বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ : আওয়ামী লীগ আমলে দেশে ফিরতে পারেননি। এমনকি তার মা আয়ারল্যান্ডে ইন্তেকাল করলেও তার লাশের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারেননি। আওয়ামী শাসনামলে যখন কেউ সোচ্চার ছিল না, সরকারের বিরুদ্ধে তখন তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। তার প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বিশাল প্রতিবাদী গোষ্ঠী। বিপ্লবী সিরাজ সিকদার হত্যা মামলার বাদী হিসেবে তার ওপর আওয়ামী সরকারের ছিল সবচেয়ে বেশি ক্রোধ। কারণ এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ নিউজ ডট কম নামের একটি পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে আওয়ামী সরকারের আতঙ্কে পরিণত হন তিনি। এমনকি সাগর-রুনী হত্যার তদন্তে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন নিউইয়র্ক থেকে ঘোষণা করেন যার প্রধান ছিলেন একজন আইরিশ মন্ত্রী। এই বিষয়টি আইরিশ পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয় এবং প্রস্তাব পাস হয়। শেখ মহিউদ্দিন গোয়েন্দা সূত্রেই নিশ্চিত ছিলেন যে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেই তাকে গুম করে দেওয়া হবে। তাই তিনি আয়ারল্যান্ড থেকে দেশে ফেরায় বিরত থাকেন। এর আগে ২০০৫ এর ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি তিন বছরের অধিককাল সোজা হয়ে হাঁটতেও পারতেন না। সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছিলেন এবং এয়ারপোর্টে তাকে থামানো হয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে তাকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়। তিনি গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি গিয়ে দেখতে পান, তার বসতবাড়ির অর্ধেক দখল করে নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় এক নাগরিক ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তার বসতবাড়ি দখল করে নেওয়া হয়। পরে তিনি আবার দেশত্যাগ করেন। আলাউর খন্দকার আমেরিকায় বসবাস করেন। আমেরিকা বাংলা চ্যানেল নামে একটি টিভিতে টকশো করে হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মুন্নী চৌধুরী মেধাসহ আরও অনেকেই অন্যতম। যারা ছিলেন নিয়মিত সরব। এ ছাড়া কানাডা থেকে ফেস দ্য পিপল নামে টকশো করে শেখ হাসিনা সরকারের কাছে বিতর্কিত হন ফ্রান্স থেকে সেসময় শরীফ ও সিডনি থেকে বনী আমীন। তা ছাড়া টকশোতে অতিথি হয়ে মালয়েশিয়া থেকে ডাক্তার ফয়জুল হক, সাকিব আলীসহ অনেকে হাসিনা সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আরিফ আল মাহফুজ লন্ডন থেকে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অনলাইনে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২৪
এসআইএস