ঢাকা: মহান মুক্তিযুদ্ধে যে প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ জীবন দিয়েছিল, সেটি গত ৫৪ বছরেও পূরণ হয়নি। নিজেদের মধ্যে বিভাজন ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার কারণে বারবার সংগ্রাম করেও তৈরি করা যায়নি একটি বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত মানবিক রাষ্ট্র।
রোববার (১৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটির কনফারেন্স হলে দৈনিক কালের কণ্ঠ আয়োজিত ‘বিজয় দিবস: নতুন প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই প্রত্যাশা করেন।
দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান, একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও রামরুর চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান খান, গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক থোয়াই চিং মং সাক, লেখক ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র তাহসিন রিয়াজ।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার ডিএমডি কাদের গণি চৌধুরী গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক লুৎফর রহমান হিমেল ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন পাভেল প্রমুখ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান বলেন, আমরা আরও স্থিতিশীল হতে পারতাম। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হয়েছে। তাদের কাজ করার সদিচ্ছা আছে। কিন্তু বাইরের একটি শক্তি বারবার বিভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিপ্লব এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও বিচক্ষণতার দরকার আছে, শক্ত হওয়ার দরকার আছে।
সরকারের ভেতরে সরকার আছে মন্তব্য করে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. সুব্রত চৌধুরী বলেন, যেসব কথা তারা বলছে, আমার মনে হয়, একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করে তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) মাঠে নেমেছে। ১০টি কমিশন করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটির কিছুটা কাজ দেখছি, বাকিগুলোর তো কোনো খবর পাচ্ছি না। অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কিছু উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করছেন। এমন সব উদ্ভট কথা বলছেন, খামোখা ভেজাল সৃষ্টি করছেন, এদের থামান। লাগামহীন কথাবার্তা বললে তাদেরও পালিয়ে যেতে হবে। ১/১১-এর সময় অনেকে পালিয়ে গিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিচার বিভাগের সংস্কার খুবই জরুরি। কোনো রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া ন্যায়বিচার এখানে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, এটা সম্ভব না। আমরা আর ক্রান্তিকালে থাকতে চাই না। আমরা নতুন প্রত্যাশা, নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে চাই। দয়া করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। এতে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে।
চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমাদের পারিবারিক ও পেশাগত জীবনসহ সব জায়গায় মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। যার কারণে আমাদের আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এসে আলোচনা করতে হচ্ছে, আমরা কী অর্জন করেছি, কী করিনি; আমাদের সফলতা কতটুকু, ব্যর্থতা কতটুকু? এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা সবাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমরা হলাম, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। গত ৫৪ বছরে যে প্রত্যাশা আমাদের ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে, সেটি আগামীতেও হবে যদি প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের জোশের সংমিশ্রণ ঘটানো না যায়। আমার প্রত্যাশা একটি সুন্দর বাংলাদেশ হোক, জনগণের বাংলাদেশ হোক, আমাদের সবার শান্তির বাংলাদেশ হোক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তার হাত ধরেই ১৯৭২ সালে সংবিধানে অনেক আপত্তিকর আইন সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এত আত্মত্যাগের পরেও অর্জন বলতে কিছু নেই। এটা আমাদের অনুধাবন করা খুব জরুরি। শুধু শেখ মুজিবের ওপর যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়েছে গত দেড় যুগে, সেই অর্থ দিয়ে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও দেখা যাবে না উপাচার্যরা পালিয়ে যায়। কোনো প্রধানমন্ত্রী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে গুম খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তাহলে কী নাটক লিখলাম আমরা এতদিন? কেন আমরা প্রতি বছর বিজয় দিবস পালন করছি? যদি সব সংস্কার করতে হয়, তাহলে আমরা এতদিন কী করেছি? আমরা বারবার এই কাজটি করছি। আমরা একসাথে বসি, কথা বলি, আবার ভুলে যাই, আবার আমাদের বিপ্লব করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, স্ববিরোধমুক্ত যদি না হতে পারি, শতচেষ্টার সবই ব্যর্থ হবে। আমরা এই ৫৩-৫৪ বছরে তাই দেখলাম। আমরা আর বিপ্লব, অভ্যুত্থান চাই না। আমরা বিজয় চাই। ১৬ ডিসেম্বর যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য না আসে। যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছে, সেটা যেন সার্থক হয়। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের চেতনার জায়গায় এই পরিবর্তনটি অতি জরুরি। এটা উপলব্ধির বিষয়। যারা সরকার পরিচালনায় আছে, তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। পতাকা রক্ষা করার সংগ্রামকে সামনে রেখে যদি আমরা কাজ করি তাহলে বিভাজন কমে আসবে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বলেন, সকলে মিলেমিশে আমরা একটি সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে চাই। এই মেলবন্ধন আমাদের মধ্যে তৈরি হোক। আমাদের মধ্যে যেন কোনো বিভাজন আর তৈরি না হয়।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, গত ৫৪ বছরে আমাদের সব সরকার খুনি, দুর্নীতিবাজ সরকারের তকমা নিয়ে ফেরত গেছে। আমি চাই না আর কোনো সরকার খুনি, দুর্নীতিবাজের তকমা নিয়ে ফেরত যাক। নতুন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাবে, তারা এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মেনে চলবে এবং সংস্কার অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যেও একটি বড় পরিবর্তন প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং শোষণ ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলাম; সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আগামী দিনে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, ছাত্র সবাইকে এমনভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত, যাতে বাংলাদেশে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ যেন ভোটাধিকারের মাধ্যমে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে এবং সেই প্রতিনিধিরা যদি জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারে, তাহলে যেন আন্দোলন ছাড়াই ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করার সুযোগ তৈরি হয়।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার ডিএমডি কাদের গণি চৌধুরী বলেন, আমাদের জাতির জীবনে বিজয় দিবস এক অতিশয় গৌরবময় দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে যুগ যুগ ধরে এই দিনটি আমরা পালন করে আসছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ যে কোনো সময়ের তুলনায় ভিন্ন রকম সময়ের সাক্ষী। ছাত্র অভ্যুত্থানে জবরদখল পাথরের মতো বসে থাকা ফ্যাসিস্টদের উৎখাত শুধু দেশে নয়, সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশের তরুণ সমাজের বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বে লাখো জনতা রাজপথে নেমে এসে নির্ভয়ে লড়াই করে রক্ত দিয়েছে। মাত্র এক মাসে দীর্ঘ ১৫ বছর জাতির ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরাচারকে ছাত্র-জনতা তাড়িয়েছে। তাই এবারের বিজয় দিবস নতুন সংকল্প ও নতুন প্রত্যয় নিয়ে উদযাপিত হবে।
কাদের গণি চৌধুরী আরও বলেন, গত ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই দ্বিতীয় বিজয় অর্জনের পর আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছি। আমরা কি আবার ভোটাধিকারহীন থাকব নাকি আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়তে পারব, সেই বিষয়টি সুরাহার সময় এসে গেছে। একাত্তরে আমরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্বাদ সত্যিকার অর্থে কি জনগণ পেয়েছে? যদি পেয়ে থাকে তাহলে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর কেন ২০২৪ সালে এসে আমাদের বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার জন্য জীবন দিতে হবে? এতগুলো ছাত্রকে কেন গুলিবিদ্ধ হতে হবে? জাতীয় পতাকা পেলেও আমরা জনগণ দেশের মালিকানা ফেরত পাইনি। বেদনার অঙ্কুরিত কণ্ঠে এখনো লিখতে হচ্ছে। এজন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দেয়নি।
তিনি বলেন, আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ চাই। আজকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমরা চাই, আর কোনো ফ্যাসিস্ট যেন এদেশে ফিরে না আসে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
এসসি/এমজেএফ