ঢাকা: উপসচিব পদোন্নতিতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং বাকি ২৫ ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব হাস্যকর ও অযৌক্তিক উল্লেখ করে শতভাগ সব ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
তারা বলছেন, উপসচিব পদে কোনো কোটা মেনে নেওয়া হবে না।
পাশাপাশি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে অন্যায়ভাবে করা বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করা না হলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদভুক্ত সব ক্যাডার কর্মকর্তারা কর্মবিরতিসহ ধারাবাহিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ও বৈষম্যমূলকভাবে সাময়িক বরখাস্তের প্রতিবাদে এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।
সম্মেলনে বলা হয়, সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন ঢাকায় সমাবেশের আয়োজন করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আল্টিমেটাম দেয় এবং সে সময়ে ও পরবর্তী তারা অন্য ক্যাডারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি করেন। এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘেরাও করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ২৫টি ক্যাডারের সদস্যদের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়।
গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়াধীন দপ্তর/সংস্থায় কর্মরত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মত প্রকাশের জন্য ঢালাওভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে সামান্য অজুহাতে এ ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা মৌলিক অধিকার ও চাকরিবিধির পরিপন্থী। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এভাবে বরখাস্ত করায় পরিষদ সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
পরিষদ মনে করে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রত্যয় নিয়ে ছাত্রজনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করায় পরিষদ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস গঠনসহ বর্তমান সরকার যে সকল সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে পরিষদ। পরিষদ মনে করে, এভাবে সাময়িক বরখাস্ত অব্যাহত থাকলে সিভিল সার্ভিসে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে। এমতাবস্থায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে জারিকৃত সাময়িক বরখাস্তের আদেশসমূহ প্রত্যাহার করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতিদানের অনুরোধ জানাচ্ছি। অন্যদিকে, প্রশাসন ক্যাডারের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ থাকলেও, সে বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক এরূপ অন্যায় আগ্রাসনের বিষয়ে ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ ও সংশ্লিষ্ট ক্যাডার অ্যাসোসিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে এবং এই অন্যায় আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। উপদেষ্টাগণ আমাদেরকে আশ্বস্ত করলেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে এখনো সাময়িক বরখাস্ত চলমান রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এসকল অন্যায় বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করা না হলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদভুক্ত সকল ক্যাডার কর্মকর্তাগণ কর্মবিরতিসহ ধারাবাহিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবে।
সেবামূলক সিভিল সার্ভিস তৈরিতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ কয়েকটি কমিশনের নিকট আমাদের সুস্পষ্ট দাবিসমূহ- ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার; ডিএস পুলে কোটা বাতিল এবং সকল ক্যাডারের সমতা উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের উপস্থাপিত রিপোর্টে ২৫ ক্যাডারের দাবির প্রতিফলন ঘটেনি।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছিলাম গঠিত পক্ষপাতমূলক জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দ্বারা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। আমাদের আশংকাই সঠিক হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অস্পষ্ট রিপোর্ট ও জনবিরোধী প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যান করছি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে সব ক্যাডারের নামের সঙ্গে ক্যাডার শব্দটির পরিবর্তে সার্ভিস শব্দটি ব্যবহার করা হলেও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস শব্দটি ব্যবহার করে প্রশাসন ক্যাডারকে আরও বেশি ক্ষমতাধর করার চেষ্টা করা হয়েছে। সকল ক্যাডারেই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পদ রয়েছে। সুতরাং কোনো ক্যাডারের নামের সঙ্গে 'অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ' শব্দ রাখা অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয়, বিভ্রান্তিকর ও আপত্তিকর। বিপত্তি এড়াতে বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের পরিবর্তে বিসিএস ভূমি সার্ভিস নামকরণ করতে হবে।
জনসেবা নিশ্চিত করতে 'ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার' প্রস্তাব সারাদেশের মানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে, অথচ কমিশনের রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে- তা উল্লেখ করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি সেক্টরের নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা-প্রণয়ন করেন উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা। আমাদের দেশের সকল সেক্টরে অনভিজ্ঞ, অদক্ষ ও অপেশাদারদের হাতে থাকায় দেশের প্রতিটি সেক্টরে অনগ্রসরতা সুস্পষ্ট। এ কারণে আমরা উপসচিব পদে কোটা বাতিল করে সকল ক্যাডারের মধ্যে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে শতভাগ নিয়োগের দাবি করা হয়েছে, যেন অভিজ্ঞদের দ্বারা জনসেবা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং বাকী ২৫ ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ ভাগ দিয়ে হাস্যকর ও অযৌক্তিক প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। উপসচিব পদে কোনো কোটা মেনে নেওয়া হবে না। কমিশনের এ প্রস্তাব সংশোধন করে শতভাগ সকল ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। ২০২৪ সালে আমাদের বীর ছাত্ররা চাকরিতে প্রবেশকালের যে ৫৬ শতাংশ ‘কোটা বৈষম্য’ দূর করতে তাদের বুকের রক্ত ঝরালো, তারাই যখন চাকরিতে প্রবেশের পর বৈষম্যমূলক কোটার সম্মুখীন হবে তখন তাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার বহির্ভূত করার প্রস্তাব করতে চেয়েছিল। তাদের প্রস্তাবে সরাসরি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার বহির্ভুত করার প্রস্তাব না রাখলেও সুকৌশলে শব্দসমূহ ব্যবহার করা হয়েছে, নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা রাখা হয়েছে। যেন ধীরে ধীরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার থেকে বের করা যায়। আমরা এ ধরনের চতুরতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। জুলাই বিপ্লবের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো প্রকার 'কোটা' মেনে নেবে না আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, কিছু প্রস্তাব সংবিধান ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া, রিপোর্টের কিছু প্রস্তাব একে অপরের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেলে, খুঁটিনাটি যাচাই করে লিখিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে।
লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মো. শওকত হোসেন মোল্যা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গণপূর্ত ক্যাডারের মো. জামিলুর রহমান, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ডা. মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন, শিক্ষা ক্যাডারের ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান, প্রাণিসম্পদ ক্যাডারের ড. মুহাম্মদ আহসান হাবীব, কৃষি ক্যাডারের মো. মমিনুল হক ও ফাতেহা নূরসহ বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্যবৃন্দ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫
এমআইএইচ/এমজে