ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার (তদন্ত), মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ বিচারক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেছেন, দুদক বাস্তবতায় বিশ্বাসী, আবেগে নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করতে চায় আমরা স্বাগত জানাব।
সেগুনবাগিচার দুদক কার্যালয়ে বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এসব কথা বলেন।
আবেগতাড়িত হয়ে দুদক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না বরং ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই দুদক সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বলেও এসময় তিনি উল্লেখ করেন।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদক সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত থেকে স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেই কাজ করে তদন্ত রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে। এ নিয়ে কোনো মহলের বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ নেই। যদি দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে কারও কোনো বক্তব্য থাকে সেক্ষেত্রে যে কোনো চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করতে রাজি আছি। আমরা আহ্বান জানাব তথ্য-প্রমাণসহ তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। পদ্মা সেতুর দুর্নীতিকে কাল্পনিক ও কথিত বলে দাবি করেন দুদকের এই কমিশনার।
কোনো কোনো গণমাধ্যমের মেলপ্রাকটিসের (অপচর্চা) ওপর দুদক চলবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফ্যাক্টস এবং বাস্তবতার ওপর কাজ করছে দুদক। মিডিয়াতে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক লেখালেখির কারণে মানুষের মধ্যে একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে আবার সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে সেই মিডিয়া। গোয়েবলসীয় কায়দায় পদ্মা সেতু নিয়ে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে আমি মনে করি। আইন এবং ঘটনাক্রমের বাইরে বিচরণের সুযোগ দুদকের নেই। আমাদের কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় এনে বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করা।
দুদক কমিশনার বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে তদারকি প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম দাবি করে দেশের কোনো কোনো গণমাধ্যম দুর্নীতির আভাস সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। একইভাবে বিশ্বব্যাংকও পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির আভাস পেয়েছে দাবি করলে সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংককে সহযোগিতায় দুদক রাজি হয়। প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিবেচনায় রেখে দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকও অনুসন্ধান শুরু করে। বিশ্বব্যাংক (তাদের ভাষায়) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীদের নিয়ে তিন সদস্যের একটি প্যানেল তৈরি করে এবং দুদকের কাছে রেফারেল অনুরোধ পাঠায়।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের পাঠানো রেফারেল অনুরোধে পদ্মা সেতুর কাজ ভাগাভাগির প্রশ্নে কিছু লোকের নাম দিয়ে বলা হয়, মোট ৩৭ কোটি টাকা ভাগাভাগি হয়েছে পুরো কাজটি কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির পক্ষে দিয়ে দিতে। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, তারা যে চিঠিটি আমাদের দেয় সেখানে স্পষ্টভাবেই নির্দেশনা থাকে যে এর গোপনীয়তা রাখতে হবে এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? যেহেতু বিষয়টি দেশ ও জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তাই দুদক অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেয়।
তখন দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা প্রমাণ করতে হলে তাদের দালিলিক কিংবা প্রামাণ্য তথ্য পরিবেশন করতে হবে কিংবা কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক এবং কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশ আমাদের কিছুই দিতে পারেনি। তখন জাতিসংঘ প্রদত্ত বিধান ও আইন অনুযায়ী যেহেতু আমরা এমএলএআরের সদস্য সেই হিসেবে আমরা এ সুযোগটুকু গ্রহণ করি।
একপর্যায়ে বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের নেতৃত্বে তখন আমাদের একটি টিম যায় কানাডায়। সরকারি কোনো তথ্য না পাওয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় এর বিচার প্রক্রিয়ার একটি ট্রান্সক্রিপ্ট আমরা সংগ্রহ করি। সেখানে আমরা পদ্মা সেতু নিয়ে আনীত অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাইনি।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কাজে পাঁচটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নেয়। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, কানাডার এসএনএস লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ সাহা নাকি প্রভাবশালী মহলকে পার্সেন্টেজ দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। অন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল যুক্তরাজ্যের দুটি, নিউজিল্যান্ড ও জাপানের দুটি কোম্পানি। সেক্ষেত্রে কানাডার বাইরে বাকি চারটি সংক্ষুব্ধ কোম্পানি যথাক্রমে (২, ৩, ৪ ও ৫) কোনো ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দাবি করেনি দুদকের কাছে এবং কখনো মূল্যায়ন কমিটির পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও আনেনি।
দুদক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই চারটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যোগাযোগ করেছে। ই-মেইলের মাধ্যমে তারা সুস্পষ্টভাবেই জানিয়েছে, তারা অবমূল্যায়িত হয়নি। এই মূল্যায়নের প্রতিটি পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি ড. দাউদ উপস্থিত থেকেছেন এবং মূল্যায়ন স্বচ্ছভাবে হয়েছে বলে নিজ হাতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের কোনো মন্ত্রী কিংবা রাজনীতিক আমাদের কাছে কোনো অনুরোধ করেননি। দুদক সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলে দাবি করেন তিনি।
দুদককে নিয়ে টিআইবির সমালোচনার জবাবে কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, প্রয়োজনে দুদকের অনুসন্ধানের ব্যাপারে টিআইবি তদন্ত করুক, আমরা স্বাগত জানাব।
বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১০