ছেউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া (লালন উৎসব) থেকে: বাউল ধারণাটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনো ব্যবস্থা থেকে জন্ম নেয়নি। ফলে শব্দটি কোনো বিশেষ তন্ত্রকে স্বীকার করে না বা মানে না।
লালন বলেন, ‘বাউল বাকিতে বিশ্বাস করে না। এ জন্মেই সব, দেহটাই প্রধান। মৃত্যুর পরে নয়, জীবদ্দশায়ই পাপ পুণ্যের বিচারের রায় কার্যকর হবে। ’
এই যে নিঃশ্বাসে বাতাস আসা যাওয়া করছে, এই বাতাস থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি। বাউলকে বলা যায় একই সঙ্গে বাস্তববাদী এবং যুক্তিবাদী। এই বাস্তববাদী দর্শনই বস্তুবাদী দর্শন বা লোকায়ত দর্শন। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা শুধুমাত্র ভাববাদী বা ঈশ্বরবাদী। লালন জাত-ধর্মের উর্ধ্বে চিন্তা করেছেন, কোনো ধর্মকে খাটো করেও দেখেননি আবার গ্রহণও করেননি। সব ধর্ম-বর্ণ মানুষের মধ্যেই স্রষ্টাকে দেখেছেন ফকির লালন।

লালনের এই লোকায়ত দর্শনই ধারণ করে চলেছেন তার ভাবশিষ্য, অনুসারী বাউলরা। শিক্ষা-দীক্ষার মানদণ্ডে তারা ঠিক এমনটাই বিশ্বাস করেন, তা হয়তো নয়। কিন্তু তাদের সবাই একটি জায়গাতে এসে একে অপরের সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে গেছেন। সে জায়গাটি হলো, ‘মানুষ পরিচয়। ’ নারী-পুরুষের জৈবিক সম্পর্কটিও তারা অস্বীকার করছেন না। কেউ সাধনসঙ্গী পেয়েছেন, কেউ হয়তো খুঁজছেন বা খুজেঁ চলেছেন।
সেই বাউলরাই ‘আরশি নগরের’ খোঁজে লালনের ১২৪ তম তিরোধান দিবসের উৎসবে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেউড়িয়ায় ছুটে এসেছেন। কেবল বাউলরাই নয়, এসেছেন হাজার হাজার লালন ভক্ত, অনুসারী ভাবশিষ্য।
দুপুরের আগেই ছেউড়িয়ার কালিগঙ্গা নদীপাড়ের লালন আখড়ায় মানুষের ঢল নামে। ভক্ত-অনুসারী, বাউলরা যে যার মতো আসন পেতে নিয়েছেন লালন একাডেমী এবং লালন মঞ্চের আশপাশের এলাকায়। লালন মঞ্চের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাউলদের নিজস্ব আসরও ছিল অসংখ্য। প্রত্যেকটি আসরেই লালনের গান।
লালন মঞ্চের মাঠজুড়ে সামিয়ানা টাঙানো। তার পশ্চিম পাশের কোনায় এক আসরে বাউল হীরামন একতারা হাতে নিয়ে গান ধরেছেন..

‘একেক দেশে একেক বাণী
পাঠান কি সাঁই গুনমনি
মানুষের রচিত জানি
লালন কেন্দে কয়..’
আসর ঘিরে জমাট ভীড়। আসরের মাঝখানে কোমর দুলিয়ে গান করছেন মধ্যবয়সী হীরামন বাউল। দু’জন ভক্ত গৌড়-নিতাই ভঙ্গীতে দুলছেন তার সাথে সাথে। ভারতের চব্বিশ পরগনার কালিগ্রম থেকে আসা মো. ইসলাম কল্কিতে লম্বা দম নিয়ে একরাশ ঘন ধোঁয়া ছাড়লেন।
গানটির কয়েক পদ গেয়ে হীরামন বাউল প্রশ্ন রাখলেন, দুনিয়ার সবাই যদি একই খোদার সৃষ্টি হবে, তবে সেই খোদার এতো নাম কেন? কেন এত জাত ধর্ম? কোরান, বেদ-বাইবেলে একই খোদার এত ভিন্ন মত কেন? সাঁইজি এই গানে এটাই প্রশ্ন রেখেছেন।
এমন আরো অসংখ্য আসরে নেচে নেচে, দুলতে-দুলতে বাউল গেয়ে চলছেন লালনের গান। রাত বাড়লেও উৎসব অঙ্গনের ভীড় এতটুকু কমেনি। বরং প্রতিটি ভক্ত, অনুরাগী একে একে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন লালনের গানে।
বৃহস্পতিবার লালনের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন ভক্ত, সাধু-গুরু কর্তৃপক্ষের দেয়া সকালের অধিবাসে বাল্যসেবা গ্রহণ করেন। দুপুরে কালীগঙ্গায় স্নান-গোসল সেরে হাজার হাজার বাউল, সাধু, ফকির পুণ্যসেবা (দুপুরের খাবার) গ্রহণ করেন।
জাত-পাত, শ্রেণি ধর্মের বালাই নেই। নেই নারী-পুরুষের সামাজিক বৈষ্যম্যের কোনো ছাপ। যেনো সম্প্রীতির অন্য এক ধর্ম, অন্য এক পৃথিবী। আর সে টানেই দলে দলে হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছে ছেউড়িয়ায়।
মূল গেট থেকে ভেতরে ঢুকে অডিটোরিয়ামের নিচে সাধু-সন্ত, ফকির-সন্ন্যাসীরা নিজেদের মতো জায়গা বেছে নিয়েছেন। আগরবাতি, ধূপের ধোঁয়া আর লালনের গানে অন্য রকম এক আবহ। দর্শনার্থী ছাড়া লালন ভক্তদের প্রায় সবাই গায়ে জড়িয়েছেন শ্বেতবসন। গেড়ুয়া বসনেও এসেছেন সাধু-সন্ন্যাসীরা।
লালন স্মরণোৎসব উপলক্ষ্যে লালন আখড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বসেছে মেলা। প্রতি বছরের মতো এবারও লালনের আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছে।
একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনভূমি ছেউড়িয়া। একই সঙ্গে চলছে দীক্ষাপর্ব।
লালন তার জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় আখড়া বাড়িতে ভক্ত-অনুসারীদের নিয়ে সারা রাত গান-বাজনা ও নানা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন। তার তিরোধানের পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। সারা আখড়া বাড়ি ও মাঠ এখন গানের মঞ্চ। ছোট ছোট আসরে মূখর আখড়া বাড়ি, কালিগঙ্গার তীর।
‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে, বদ হাওয়া লেগেছে পাখির গায়, বাড়ির পাশে আরশী নগর, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আল্লা বাদশা আলমপনা তুমি’ এ রকম অসংখ্য লালন সঙ্গীত লালন একাডেমির শিল্পী ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাউলরা পরিবেশন করে চলেছেন।

এছাড়া লালন মাজারের আশপাশে ও কালীগঙ্গা নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করছেন তার অমর বাণী পরিবেশনের মাধ্যমে।
স্মরণোৎসবের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হয় আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গওহর রিজভী। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম, জেলা পরিষদ প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফর প্রমুখ।
মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট লালন গবেষক ও লেখক ড. আনোয়ারুল করিম। আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন লালন একাডেমীর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম হক।
আলোচক হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, লালন মাজারের প্রধান খাদেম মোহাম্মদ আলী, কুমারখালী উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেলা আক্তার।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেলার মাঠের স্থায়ী মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা ও লালনের গান। এবারের স্মরণোৎসবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে দেশের বেসরকারি মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক।
** ‘লালনই পারে মানুষকে এক করতে’
** ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৪