ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আজহারের ফাঁসি

বাংলানিউজ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
আজহারের ফাঁসি ছবি: কাশেম হারুন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক আটকে রাখা, নির্যাতন ও লুটপাটের পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর জেলা আলবদর বাহিনীর এই কমান্ডারের মামলার রায়ে তাকে সর্বোচ্চ এ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।



মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শত শত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯ ধরনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)/এ, ৩(২)/সি, ৩(২)/ডি, ৩(২)/জি ও ৩(২)/এইচ এবং ৪/১ ও ৪/২ ধারা অনুসারে এসব অভিযোগ গঠন করা হয়।

এসব অভিযোগের মধ্যে ১ নম্বর বাদে বাকি পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির(উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ ছাড়াও তিনি যে আলবদর কমান্ডার ছিলেন তাও প্রমাণিত হয়েছে রায়ে।

রায়ে ২ নম্বর (ধাপপাড়া গণহত্যা), ৩ নম্বর (ঝাড়ুয়ারবিল গণহত্যা) এবং ৪ নম্বর (রংপুর কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পত্মীকে হত্যা) অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়েছেন আজহার। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে এক নারীকে ধর্ষণ ও পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণে সহায়তার দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরসহ আরও ৩০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে।

তবে ১ নম্বর অভিযোগ (মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে গণহত্যা) প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।

আজহারের বিরুদ্ধে রায়ে বলা হয়েছে, রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে আজহার জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার সভাপতি ও ওই জেলার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। আসামি আজহার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজন, মুক্তিকামী বাঙালি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দিতেন এবং তাদের হত্যা, গণহত্যা, আটক ও নির্যাতনে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র করে তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে এসব অপরাধ সংঘটন করেন এটিএম আজহার। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদরের নেতৃত্বে থাকায় তার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির  (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে রায়ে।

এছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে আজহারের নির্যাতনের শিকার একজন বীরাঙ্গনাকে পুনর্বাসন করতে রাষ্ট্রকে বলেছেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের আত্মত্যাগ তুলে ধরতে পাঠ্যপুস্তকে বীরাঙ্গনাদের বিষয়টি তুলে ধরতে বলা হয়।  
Jalget_1_banglanews24
ওই বীরাঙ্গনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন প্রসিকিউশন। আজহারের বিরুদ্ধে ওই বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর টাউন হলে স্থাপিত পাকিস্তানি ও রাজাকার ক্যাম্পে আজহারের নেতৃত্বে ধর্ষণ ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি।

তিন অপরাধে ফাঁসি
প্রমাণিত তিনটি গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে এটিএম আজহারুল ইসলামকে।

প্রমাণিত দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, আজহারের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে এটিএম আজহারুল ইসলাম নিজেও এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। ওই ঘটনায় শহীদদের মধ্যে ১৪ জনের নাম-পরিচিতি শনাক্ত করা গেছে।

প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারের নেতৃত্বে  ১৭ এপ্রিল নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২২৫ নিরীহ লোক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন। ওই ঘটনায় এক হাজার ২২৫ জন শহীদ হন, যাদের মধ্যে ৩৬৫ জনের নাম-পরিচিতি পাওয়া গেছে। শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ, কেউ ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাদ যাননি। গণহত্যার শিকারদের মধ্যে ২০০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, যা প্রমাণ করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল।

প্রমাণিত চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারের নির্দেশে ১৭ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পত্মীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। সেদিন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচান রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন রায়কে হত্যা করা হয়।

ধর্ষণের দায়ে ২৫ বছর
এক নারীকে ধর্ষণসহ রংপুর টাউন হলে পাকিস্তানি ও রাজাকার ক্যাম্পে নারীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণে সহায়তার অপরাধও প্রমাণিত হয়েছে। এ অপরাধে আজহার পেয়েছেন ২৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ।

প্রমাণিত পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারুল ইসলামের পরিকল্পনায়  ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা বয়সী নারীদের ধরে এনে রংপুর টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। সে সময় নারীদের ধরে এনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অফিসারদের ভোগের জন্য তুলে দেওয়া হতো। রংপুর টাউন হলে তাদের আটক রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হতো।   একই সঙ্গে মহিলাসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর রংপুর টাউন হলের পেছনে ইন্দারায় অনেক মা-বোনের মরদেহ পাওয়া যায়।

নির্যাতনে ৫ বছর
প্রমাণিত ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে এজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করেন আজহার।

নির্যাতনের এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আরও ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন আজহার।

এক অভিযোগে খালাস
প্রমাণিত না হওয়া প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদের ৩ এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালানো হয়।

এ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন আজহার।

বেলা এগারোটা ১৮ মিনিট থেকে বারটা ৩৩ মিনিট পর্যন্ত পর্যন্ত  আজহারের মামলার রায়টি পাঠ করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে রায়ের প্রথম অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারক প্যানেলের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। সবশেষে রায়ের শেষ অংশ অর্থাৎ মূল রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

মোট ১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করা হয়।

এর আগে বেলা এগারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে এসে বেলা এগারটা ১০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসন নেন বিচারপতিরা। শুরুতে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা বক্তব্য দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

বেলা দশটা ৫৩ মিনিটে আজহারকে তোলা হয়েছে আসামির কাঠগড়ায়। সকাল নয়টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে এনে হাজতখানায় রাখা হয় এটিএম আজহারকে। তার পরনে রয়েছে সাদা রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা ও ঘিয়া রঙের সোয়েটার। সকাল পৌনে নয়টার দিকে আজহারকে কারাগার থেকে বের করে তাকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় প্রিজন ভ্যানটি। পুরোটা সময় তাকে চিন্তাযুক্ত দেখাচ্ছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

** আজহারের ফাঁসির রায়ে কথা বলতে নারাজ বিএনপি
** জনগণের কাঙ্ক্ষিত রায় : গণজাগরণ মঞ্চ
** বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে
** ফাঁসির রায় ‘অষ্টম আশ্চর্য’
** কুড়িলে শিবিরের ঝটিকা মিছিল, ককটেল বিস্ফোরণ

** আজহারের ফাঁসির রায়ে কথা বলতে নারাজ বিএনপি
** কারমাইকেল কলেজের ৬ শিক্ষককে হত্যা করেন আজহার
** রায়ে সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ

** ‘আমি নিদোর্ষ, আল্লাহ আপনাদের বিচার করবে’
** জনগণের কাঙ্ক্ষিত রায় : গণজাগরণ মঞ্চ
** হত্যা-গণহত্যা-ধর্ষণের পাঁচ অভিযোগই প্রমাণিত
** সহিংস আন্দোলনে রায় পরিবর্তন করা যায় না
** আজহারের রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়া চলছে
** আজহারের রায়ের প্রথম অংশ পড়া চলছে
** আজহারের রায়ের প্রথম অংশ পড়া চলছে
** এজলাসে বিচারকরা, আজহার কাঠগড়ায়

** ট্রাইব্যুনালে বিচারকরা, কাঠগড়ায় আজহার

** ট্রাইব্যুনালে বিচারকরা

** ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় আজহার
** স্লোগানে-স্লোগানে গণজাগরণ মঞ্চের ফাঁসির দাবি
** আজহারের রায়কে ঘিরে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কড়া নিরাপত্তা

** আজহারের যুদ্ধাপরাধের রায়ের অপেক্ষা
** আজহারের যুদ্ধাপরাধের রায় মঙ্গলবার
** ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আজহার
** আজহারের সর্বোচ্চ শাস্তি চান নিজ এলাকাবাসী
** ‘আমি নির্দোষ,আল্লাহ আপনাদের বিচার করবে’
** আজহারের দন্ডাদেশে জবি ছাত্রলীগের আনন্দ মিছিল
** ট্রাইব্যুনালে উদ্ধত আজহার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।