যশোর: বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রশংসা কুড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা কার্যক্রমের অধীনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রতিবছর প্রায় চার হাজার উড্ডয়ন ঘণ্টা সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে যাচ্ছে।
বুধবার দুপুরে যশোর বিমান বাহিনী একাডেমিতে আয়োজিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমির প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় এ সব কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পরিবহন বিমানের কন্টিনজেন্ট বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমাদের বিমান বাহিনীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এ সময় তিনি প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান বাহিনীর নবীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রাথমিক ধাপ সফলতার সঙ্গে শেষ করে আজ আপনারা কমিশন পেতে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত আনন্দের। অত্যন্ত গর্বের। আমি কমিশনপ্রাপ্ত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
এ সময় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর বলিষ্ঠ ও আপসহীন নেতৃত্বে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা।
তিনি জাতীয় চার নেতাকে স্মরণ করে বলেন, আমি স্মরণ করছি, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে। স্মরণ করছি, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বিমান বাহিনীর সব সদস্যকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তিনি।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঐহিত্য উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় উপকরণ ছাড়াই শুধু একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার, একটি ডিসি-৩ এবং একটি অটার বিমান নিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী আধুনিক বিমান বাহিনীর উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোনো জাতির জন্য একটি শক্তিশালী, পেশাদার ও আধুনিক বিমান বাহিনী অপরিহার্য। একথা অনুধাবন করে জাতির পিতা স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি দক্ষ ও চৌকস বিমান বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিমান বাহিনীর জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বিদেশ থেকে আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করেন।
তিনি ১৯৭৩ সালে সে সময়ের অত্যাধুনিক মিগ-২১ সুপারসনিক ফাইটার স্কোয়াড্রন, এমআই- ৮ (এমআইএইট) হেলিকপ্টার, এএন-২৪ পরিবহন বিমান এবং এয়ার ডিফেন্স রাডার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে সংযোজন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা, সমুদ্রসীমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি ও দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে জাতির পিতা চট্টগ্রামে জহুরুল হক ঘাঁটির গোড়াপত্তন করেন। গত ৮ নভেম্বর আমরা এ ঘাঁটিকে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড প্রদান করেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উন্নয়নে অবদান রেখেছে। ১৯৯৬ সালে আমরা বিমান বাহিনীতে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান মিগ-২৯, সি- ১৩০ পরিবহন বিমান এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা রাডার সংযোজন করি।
আওয়ামী লীগ সরকার বিমান বাহিনীর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমরা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। বিমান বাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছে এফ-৭, বিজি-১, ইএ-১ যুদ্ধবিমান, এমআই-এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার, অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ও কক্সবাজার বিমান ঘাঁটি পূর্ণাঙ্গ ঘাঁটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সংযোজন করা হয়েছে বিমান বাহিনীর জন্য প্রথমবারের মতো সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম। সমুদ্রসীমার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন পর্যবেক্ষণের জন্য কক্সবাজারে স্থাপন করা হয়েছে নতুন উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এয়ার ডিফেন্স রাডার।
তিনি আরো বলেন, আমরা ঢাকায় হেলিকপ্টার ওভারহল প্ল্যান্ট স্থাপন করেছি। ৫টি নতুন এমআই-১৭১ হেলিকপ্টার, ৯টি বেসিক ট্রেইনার বিমান, ৩টি ট্রান্সপোর্ট ট্রেইনার বিমান, ২টি মেরিটাইম সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ হেলিকপ্টার এবং ১৬টি কমব্যাট ট্রেইনার বিমান কেনার জন্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। অচিরেই তা বিমান বহিনীর বহরে যুক্ত হবে।
বিমান বাহিনী উন্নয়নে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বঙ্গবন্ধুতে ‘বঙ্গবন্ধু অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিন বাহিনীর পদমর্যাদা বৃদ্ধি করাসহ সুযোগ-সুবিধার বৃদ্ধির কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা তিন বাহিনীর সদস্যদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করেছি। চাকরির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিমান বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বিমান বাহিনীতে নতুন নতুন ইউনিট স্থাপনের ফলে জনবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। পদোন্নতির পথ সুগম হচ্ছে।
তিনি জাতীয় নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিমান বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সহমর্মিতার বার্তা নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে জাপান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, চীন, ভারত, মালদ্বীপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ফোর্সেস গোল-২০৩০-এর আওতায় নতুন নতুন বিমান এবং হেলিকপ্টার যুক্ত হওয়ার ফলে এ সব কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিমান বাহিনীর সামর্থ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুইজন নারী কর্মকর্তা প্রথম সামরিক বৈমানিক হিসেবে হেলিকপ্টার উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ শেষ করে এককভাবে ফ্লাইং করতে সক্ষম হয়েছেন। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে বিমান বাহিনী আরো বেশি সংখ্যক নারী সামরিক বৈমানিককে প্রশিক্ষণ দেবে। বিমান বাহিনীতে নারীর এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।
তিনি সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত নবীন কর্মকর্তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের অভিনন্দন জানান এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান, বিমান বাহিনী একাডেমির কমান্ড্যান্ট, ফ্লাইট ক্যাডেট ও তাদের অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪