ঢাকা: অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে জোরালো পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত বক্তারা।
১৯৬৫ সাল থেকে শত্রু সম্পত্তি আইন এবং স্বাধীনতা-উত্তর কালের অর্পিত সম্পত্তি আইনের নিষ্পেষণে এ দেশের লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা ও বঞ্চনার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে এ বছরের ৯ সেপ্টেম্বর।
এ উপলক্ষ্যে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেলের নয়টি সংগঠনের যৌথ আয়োজনে সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সিরডাপ মিলনায়তনে ‘কুখ্যাত শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের ৫০ বছর : জনগণের দুর্দশা’ শীর্ষক গোলটেবিল ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবর্ণনীয় হয়রানির ওপর আলোচনাপত্র উপস্থাপন করেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।
অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মানবাধিকার কর্মী ও নারী নেত্রী খুশী কবির। এছাড়া বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার আন্দোলনের নেতাসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।
বক্তারা বলেন, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অর্ডিন্যান্স ১৯৬৫-এর ১৬৯ বিধি মোতাবেক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে সব হিন্দু নাগরিক ভারতে চলে যান বা কোনো কারণে যুদ্ধের সময়কালে ভারতে অবস্থান করছিলেন, তাদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি আখ্যায়িত করা হয়। এবং তৎকালীন সরকার এ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পাকিস্তানে বলবৎ শত্রু সম্পত্তি আইনটি প্রয়োগে ও ততধিক অপপ্রয়োগের দ্বারা লাখ লাখ হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু পরিবারের স্থাবর সম্পত্তি বেহাত বা বেদখল হয়। এ আইনের সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল নানা উপায়ে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি গ্রাস ও তাদের ওপর নানা হয়রানি ও নির্যাতন চালায়। এর ফলে সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগ বেড়ে যায়।
অনুষ্ঠানে জাতীগত ও ধর্মীয় বৈষম্য নিরসনে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদলে বাংলাদেশেও একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের সুপারিশ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম জেলা জজদের সমন্বয়ে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের আবেদনসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে বলে মত দেন সুপ্রীম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক।
অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত বলেন, শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি শুধু সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়। এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিষয়টিকে ক্ষুদ্র পরিসরে না দেখে এর বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিতে হবে।
অ্যাডভোকেট তবারক হোসেন বলেন, দেশের সব নাগরিকের দায়িত্ব হলো সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। কিন্তু ভূমি অফিসের কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ আমলা পর্যায়ে এ আইন বাস্তবায়নে চরম অসহযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে শতকরা ৯০ ভাগ হিন্দু পরিবার এ আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে ভুক্তভোগীরা তাদের পক্ষে রায় পাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নানা অজুহাত দেখিয়ে তা বাস্তবায়ন করছেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে যে সব জেলা প্রশাসক ট্রাইব্যুনালের রায় উপেক্ষা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ এবং অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী।
সংখ্যালঘুদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরও বলেন, সংখ্যালঘুদের নিঃস্বকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ১৯৫০ সালে প্রণীত রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের সময় থেকে। দেশের সবার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া রোধ করতে হবে। সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন- সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট তোবারক হোসাইন, কমরেড খালেকুজ্জামান, কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, সোহরাব হাসান, খন্দকার মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সদস্য নির্মল রোজারিও, কিউবার্ড গোমেজ, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫
জেপি/আরএম