ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

আইতে খাল যাইতে খাল, সবার সেরা বরিশাল

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫
আইতে খাল যাইতে খাল, সবার সেরা বরিশাল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুরভী ৮ লঞ্চ থেকে: সদরঘাটে টার্মিনাল দেখেই মাথা ঘোরার মতো অবস্থা। ঈদের দুদিন পরেও এতো ভিড়! মানুষের মাথাগুলো এদিক-ওদিক দ্রুত গতিতে ছুটছে।

‘গেছো’, ‘মনু’, ‘মোগো’ শব্দগুলো কানে বাজতে শুরু করে। খুব সহজেই অনুমান করা যায়, কীর্ত্তনখোলার পাড়ে স্রোতের বেগে ছুটে চলেছে মানুষগুলো।

শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) চাঁদপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলাম লঞ্চে। ঈদের দিন হওয়ার পরও ময়ূর লঞ্চটি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। তবে ঘাটে এতো ভিড় ছিল না।

এর আগের তিন বারের মতো এবারও বরিশালগামী লঞ্চে ওঠার অভিজ্ঞতা একই। লঞ্চে উঠলেই দেখা যায়, সারি-সারি মানুষ কাঁথা, চাদর বিছিয়ে বসে আছে। অনেক ভিড়েও নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন কয়েকজন। বরিশালগামী এসব মানুষদের অনেকেই হয়তো বিকেল থেকেই চাদর বিছিয়ে বসে আছেন। সহজেই অনুমান করা যায়, এ অঞ্চলের মানুষ বাস ভ্রমণে সাড়া দেন কম।

ডেকে বসা মানুষের গোল হয়ে তাস খেলার উৎসবে বোঝা যায়, বরিশালের ছেলেরা ৫২ কার্ডের খেলাতেও ওস্তাদ। নিচতলায় সাধারণ ডেকের যাত্রীরা যেন সংসার গুছিয়ে বসেছেন। হাড়ি-পাতিল, থালা-বাসনের আয়োজনে বোঝা যাচ্ছে রাতের খাবারটা ভালই জমবে।

২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো বরিশাল গিয়েছিলাম। সারারাত নৌভ্রমণের রোমাঞ্চ আমাকে তাড়া করেছিল। বুড়িগঙ্গা ধরে লঞ্চ যখন মেঘনায় এসে পড়ল, বুঝতে পারলাম লঞ্চের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার পাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটাও ধৈর্য্যের ব্যাপার। অক্টোবরের হিম বাতাসে এক সময় বন্ধুদের নিয়ে প্রবেশ করেছিলাম কেবিনে।

এরপর আবার বরিশাল যাই ২০১২ সালে। ইউএনডিপি’র একটি প্রকল্পের কাজে একা ভ্রমণ। কিন্তু কেবিনের স্টাফের সঙ্গে বসে আর কতক্ষণ গল্প করা যায়! বেশ কয়েকবার কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা হলো। এই নিরিবিলি রাতের নদীর ঢেউ দু’কলম লিখতেও দিলো না।

দেশের যে কোনও শহরের চেয়ে সড়ক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বরিশাল অনেক এগিয়ে এ ভ্রমণেই বুঝতে পারি। ২০১৩ সালের শুরুতে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা হলে তড়িঘড়ি সদরঘাটে বরিশালগামী লঞ্চের টিকিট কাটার অভিজ্ঞতা আজও স্মরণীয়। প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে অ্যাসাইনমেন্টে এসেছিলেন বাংলানিউজের ফটো করেসপন্ডেন্ট জিএম মুজিবুর। আমার ওপরে রাগ করে একরাত লঞ্চের ক্যান্টিনেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। রাতের নদীর বুক চিরে চলতে গিয়ে মানুষ যেন ধাবিত হয় অতীতে।

রাজধানীতে বিভিন্ন কর্মে ব্যস্ত কোনও মানুষের সঙ্গে সারাদিনে একজন বরিশালের মানুষের দেখা হবে না, সেটা ভাবা যায় না। নিজেদের কর্মদক্ষতা, একনিষ্ঠতা, শিক্ষা, যোগ্যতা বরিশালকে এগিয়ে দিয়েছে। মাত্র ২২ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি লাভ করা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর প্রমাণ করেছেন বরিশালবাসীরা সাহসী যোদ্ধাও বটে। দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন তারা।

দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের একটি অন্যতম উৎস বৃহত্তর বরিশাল। মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত থেকে শুরু করে, সরদার ফজলুল করিম, চারণ কবি মুকুন্দরাম, কবি সুফিয়া কামাল, কামিনী রায়, জীবনানন্দ দাশ অনেকেই বরিশালের আলো হাওয়ায় বিকশিত হয়েছেন।

মালয়েশিয়া প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা তেনেগানিতার সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কাজ করছেন তরুণ আশিকুর রহমান খান। এ বেলা তিনি আমার যাত্রা সঙ্গী।

ঈদের দুদিন পর বাড়ি যাচ্ছেন বাবুগঞ্জের বাবুল। লঞ্চের তৃতীয় তলায় কাঁথা বিছিয়ে বসেছেন তিনি। জানালেন- ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। তবে ঈদের এই সময়টা কোরবানির পশুর মাংস কাটার কাজ করে বাড়তি আয় করেন তিনি। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন বাবুল। পরিশ্রমী চন্দ্রদ্বীপের এই মানুষগুলোকে আটকাবে সাধ্য কার!

দীর্ঘদিন বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা আশিক বারবার বরিশালের লঞ্চগুলোকে নৌকা বলে সম্বোধন করছেন। অবশ্য লঞ্চের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনগুলো দেখে তার চোখ ছানাবড়া। সত্যি বরিশাল অনেক দূর এগিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২৩১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫
এমএন/এসইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।