ভীমরুলী (ঝালকাঠি) থেকে ফিরে: ‘স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা যাবে এবং তাই হয়েছে। আজ এটি বাস্তব বলেই একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বসে কথা হচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে কথাগুলো বলছিলেন কবিতা কলি। তিনিই শুধু নন, আরও আশপাশের অন্যরাও তখন এই উদ্যোগের প্রশংসায় বলে উঠলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ’।
‘তিনিই পারেন এবং পেরেছেন বলেই তাকে ধন্যবাদ। হয়ত স্বল্প সময়ে এ কথা বোঝানো যাবে না- তবে এই অজগ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকটি যে কী ভরসা-আস্থার নাম তা নিজ চোখে না দেখলে কেউ টের পাবেন না,’ সমস্বরে বললেন ক্লিনিকে কর্মরতরাসহ সাধারণ গ্রামবাসী ও সেবা নিতে আসা রোগীরা।
![](files/comi1_349491253.jpg)
ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলী গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকটি সেবা দিচ্ছে এখানকার হাজারো জনতাকে। ১নং ওয়ার্ডের জন্য এই ক্লিনিকটি প্রতিষ্ঠিত। প্রতিদিন অর্ধশত মানুষ তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসেন। হয় চেকআপ, দেওয়া হয় ওষুধ- যার সবই বিনামূল্যে। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এ ক্লিনিকটিতে বর্তমানে কর্মী সংখ্যা পাঁচজন। পরিবার পরিকল্পনায় (এফপি) দুইজন, স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএস) একজন এবং কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) রয়েছেন একজন। এছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মীও নিয়োজিত একজন।
এফপি’তে ঊষা রানী রায় ও সবিতা মিস্ত্রী। এইচএস’তে কবিতা কলি আর সিএইচসিপি’তে মনিকা রানী। প্রত্যেকেই প্রশিক্ষিত।
![](files/comi2_287009059.jpg)
শুরুতে কথা বলছিলেন কবিতা কলি। মাঝে অন্যরা যোগ দিলেও ফের কবিতার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তিনি বলেন, বিনামূল্যে সব রকম সেবা দেওয়া হয় এখানে। তবে ইউনিয়ন পরিষদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী যেহেতু অতিরিক্ত, তাই রোগীপ্রতি ২ টাকা করে নেওয়া হয়। যা দিয়ে ওই কর্মীর বেতন পরিশোধ হয়।
ঘুরে দেখা যায়, চারটি রুম নিয়ে ক্লিনিকটি প্রতিষ্ঠিত। পাকা ঘর সঙ্গে ঢালাই ছাদও আছে। রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পানি। সকাল ৯টা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। সপ্তাহে শনি-রোব ও সোমবার সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা। মঙ্গল-বুধ ও বৃহস্পতিবার পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে চলে বিস্তর আলাপ-আলোচনা পাশাপাশি সেবাদান কার্যক্রম।
‘নিয়ম অনুযায়ী এভাবে পরিচালিত হচ্ছে তবে সপ্তাহে ছয়দিনই সব রকম সেবায় আমরা নিয়োজিত। কর্মী সবাই এলাকারই বাসিন্দা। হেঁটেই ক্লিনিকে আসি-যাই। তাই যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের কাছে পান গ্রামবাসী’- বললেন সিএইচসিপি’র মনিকা রানী।
![](files/comi3_627872699.jpg)
তিনি আরও বলেন, সব রকম প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা আমরা দিয়ে থাকি। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো ইপিআই। টিকার মাধ্যমে যে আটটি রোগ প্রতিরোধ করা যায় সেগুলো দেওয়া হয় এ কার্যক্রমের আওতায়। শুধু তাই নয়, টিকা দিবসে গ্রামে বাড়ি বাড়ি প্রচার-প্রচারণাও করি নিজস্ব উদ্যোগে। আমাদের লক্ষ্যই হলো টিকাদান কর্মসূচি থেকে বাদ যাবে না একটি শিশু। সরকারের কঠোর মনিটরিংও রয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ মিটিংয়ে এ রকম নানা বিষয়ে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়।
পাশেই বসে থাকা এইচএস’র কবিতা কলি বলে উঠলেন, শুধু এখানেই নয় দেশের প্রতি গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার প্রাণকেন্দ্র| সুপ্রশিক্ষিত কর্মী দ্বারা এসব ক্লিনিক পরিচালিত। শুনেছি আরও হাজার তিনেক কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের বাড়ির পাশে চলে আসবে স্বাস্থ্যসেবা। ফলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। সে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই বর্তমান সরকার এগুচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় কমিউনিটি সেবাটি আজ জনপ্রিয়। যার সুফল ভোগ করছেন গ্রামীণ জনপদের কোটি সাধারণ মানুষ।
কবিতা জানান, ভীমরুলী কমিউনিটি ক্লিনিকে গড়ে ৪০ জন চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। কোনো কোনো সময় রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকে, তখন বার্তি রোগীদেরও সেবা দেওয়া হয়।
![](files/comi4_272318563.jpg)
কথা বলতে বলতেই রোগী চলে আসেন। চেয়ারে বসেও পড়েন দ্রুত। নাম মহেন্দ্র বেপারী। বয়স বেশি। প্রশ্ন করায় একটু ভেবেচিন্তে উত্তর দিলেন, দেশ স্বাধীনের সময় ছিল ৩৩। এখন সব মিলিয়ে ৭৬ বছর বয়স আমার। কেন এলেন এখানে? উত্তর, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি গো। তাই দেখাতে এলাম। পায়ে খুব ব্যথা। মাপাবো প্রেসার...।
আরও কথা বলে জানা যায়, পেশায় শিক্ষক ছিলেন। বছর ২০ হবে অবসরে। বাড়ি পাশের শতদশকাঠিতে। এই ক্লিনিকেই সেবা নিয়ে আসছেন গত ছয়-সাত বছর ধরে। হাঁটু ব্যথা ও শারিরীক দুর্বলতা সমস্যার জন্য এবার স্মরণাপন্ন।
মিনিট দশেক পরিচর্যায় মেপে নিলেন প্রেসার, ব্যথার জন্য বিনামূল্যে পেলেন ক্যালসিয়াম ওষুধও। সঙ্গে ঠিক মতো ডিম-দুধ খাওয়ার পরামর্শ।
চলে যাওয়ার সময় মহেন্দ্র বেপারী বাংলানিউজকে বলেন, একেবারে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসার জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র আমাদের অনেক উপকারে আসছে। যে কোনো ছোট-বড় প্রয়োজনে এখানে আসতে পারি। বেশি দূর যেতে হয় না। সব সময় ডাক্তারও পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ভালোই আছি গ্রামে। সুখেই আছি।
দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এলেন বিদ্যুৎ বাবু। বাড়ি ডুমুরিয়ায়। তিনি আমাশয়ে ভুগছিলেন, পেলেন ওষুধ। কয়েকদিন আগে জ্বর ছিল সুবর্ণার। জ্বর মেপে ফ্রিতে দেওয়া হয় ওষুধ। যার তিনদিন (ওষুধ কোর্সের) সম্পন্ন হয়েছে। এবার ফিরতি চেকআপে তিনি। আরও আসেন শতশদকাঠির রীতা, কাপড়কাঠির তুষার দৌড়ি, ভৈরমপুরের আঁখি। এছাড়া ১নং ওয়ার্ডের আওতাধীন খেজুরা, মীরাকাঠি, খোদ্দরবহর গ্রামও এই কমিউনিটি ক্লিনিকের অন্তর্ভুক্ত, রোগী আসেন সেখান থেকেও।
![](files/comi5_270776263.jpg)
কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মধ্যে রয়েছে, প্রাথমিক সমস্যার সব রকম চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ। গর্ভবতীদের নিয়মিত চেকআপ, পরামর্শ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। আধুনিক পদ্ধতিতে নরমাল নিরাপদ প্রসব। পরিবার-পরিকল্পনা সেবা। প্রাথমিক জরুরি সেবা। রোগ প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও কুসংস্কার দূর করে কাউনসেলিং করা। শিশুদের টিকা কার্যক্রম। সংক্রমক রোগের জন্য টিকা। কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা দূরকরণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক সেবা। প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পুষ্টি বিষয়ক তথ্য ও সেবা দেওয়া।
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের আওতায় রোগীর অবস্থা অনুযায়ী বিতরণের জন্য নির্ধারণ করা আছে ৩০ ধরনের ওষুধ।
স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত গ্রামীণ জনপদের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জনকল্যাণমূলক এই প্রকল্পটি চালু করে। তবে ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হলে জনপ্রিয় সেবা প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে যা আবার গতি পায় মহাজোট সরকারের আমলে। বর্তমানে দেশে ১৫ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। যা থেকে ঘরের কাছে সেবা পাচ্ছেন মহেন্দ্র, বিদ্যুৎ, সুবর্ণা, আঁখিদের মতো কোটি সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
আইএ
** যেখানে হারায় না শৈশব
** তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’