ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

ওদের দেখার কেউ নেই!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
ওদের দেখার কেউ নেই! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফেনী: এদের কারো বাবা নেই, কারো মা। কারো মা-বাবা কেউই নেই।

সব হারানো এতিম এমন অনেক শিশুদের ঠাঁই এখন ফেনীর ছাগলনাইয়া সরকারি শিশু পরিবারে।

কিন্তু সেখানেও দুর্ভোগের অন্ত নেই বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত এসব শিশুদের। ফলে অনেকটাই মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।

কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এখানে বসবাসকারী শিশুদের লাঞ্ছনা আর গঞ্জনার শেষ নেই। এমনকি অনিয়ম আর দুর্নীতিতে বাধ্য হয়ে প্রতিবাদে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ মিছিল পর্যন্ত করেছে শিশু পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু অবস্থা যেই লাউ, সেই কদু।

সরেজমিনে শিশুদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। শিশু পরিবারটিতে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে শিশুরা নিজে রান্না করে নিজেরাই খাচ্ছে। তাও আবার নিম্নমানের খাবার। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের জন্য রয়েছে সরকারি বাবুর্চি।

শিশু পরিবারের অধিকাংশ কক্ষের দরজা জানালা ভাঙা ও নড়বড়ে। কক্ষগুলোতে বৈদ্যুতিক সংযোগের অবস্থাও ভালো নয়। থাকার কক্ষগুলোসহ শিশু পরিবারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ এবং কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজগুলো করতে হয় শিশুদের নিজেদেরই।

প্রায় সবগুলো কক্ষের ফ্যান-লাইটগুলো ঠিকমতো চালু নেই। কিছু ফ্যান-লাইটের তার ছিঁড়ে গেছে, কিছু আবার বিকল ও অকেজো হয়ে আছে। এর ওপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে রাতের বেলায় পড়াশোনা ও ঘুমাতেও বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এসব শিশুদের। তাদের বিছানা, বেডশিট, বালিশ ও বালিশের কভার অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন। বেশ কিছু আবার ছেঁড়া।

শিশু পরিবারের টয়লেটগুলোর অবস্থাও নাজুক। মেঝেতে ময়লা পানি জমে রয়েছে। উৎকট দুর্গন্ধে তা অনেকটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

সূত্র জানায়, শিশু পরিবারের বাসিন্দাদের দেখভাল করার জন্য আটজন তত্ত্বাবধায়ক পদ থাকলেও আছেন মাত্র দুইজন। চার বছর ধরে প্রধান তত্ত্বাবধায়ক পদে কেউ না থাকায় উপ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আফতাব উদ্দিন চৌধুরী।
 
শিশুদের অভিযোগ, উপ তত্ত্বাবধায়ক প্রায় চার বছর ধরে দায়িত্বে আছেন। এ সময়ে তিনি শিশু পরিবারকে অনেকটা ‘শিশু জেলখানা’ বানিয়ে ফেলেছেন। এ চার বছরে শিশুদের স্কুল ইউনিফর্ম দেওয়া হয়নি। ইউনিফর্ম না থাকায় স্কুল শিক্ষকের কাছে অনেককে মারও খেতে হয়েছে।

ফেনী কম্পিউটার ইনস্টিটিউটে পড়ুয়া শিশু পরিবারের সদস্য তানভীর জানায়, পাবলিক পরীক্ষার্থী হিসেবে আমাকে পরীক্ষার সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র ২ দিস্তা খাতা ও ২টি কলম। অথচ দেওয়ার কথা ছিল ৪ দিস্তা খাতা ও ১ ডজন কলম।

সে আরও জানায়, বর্তমান কোর্স শেষ হতে তার আরও ২ বছর লাগবে। অন্য শিক্ষার্থীর মতো আমিও আমার সময় বাড়ানোর জন্যে স্যারের কাছে লিখিত আবেদন করেছি। কিন্তু স্যার তাতে সাড়া দেননি।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মনির হোসেন বলে, আমাদের ডাইনিংয়ে সপ্তাহে একদিন গরুর মাংস দেওয়ার নিয়ম থাকলেও গত কয়েকমাস ধরে তা দেওয়া হচ্ছে না।

সে জানায়, যদি কোনো ব্যক্তি শিশু পরিবারে দুপুরের খাবার দেন, তবে স্যার ওই বেলার খাবারের টাকা বাঁচিয়ে ফেলেন। অন্য বেলায় তা আর দেওয়া হয়না।

ফলে বাধ্য হয়ে একটু ভাল খাবারের আশায় শিশু পরিবারের কয়েক ছাত্র বাইরে কাজ করে বলেও জানায় সে।

চিকিৎসা প্রসঙ্গে শিশু শিক্ষার্থী আবু তৈয়ব বলে, কারো সামান্য অসুখ হলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি যাদের দূরে তাদের সামান্য ওষুধ দেওয়া হয়।

আরেক শিক্ষার্থী আশরাফ জানায়, তার ছোট ভাই মামুনের কিছুদিনের ব্যবধানে দুইবার বুকে ব্যথা ওঠে। তখন উপ তত্ত্বাবধায়ক ধমকের সুরে বলেন, ‘আবার অসুস্থ হলে মামুনের নাম কেটে দেব’।

দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া আলমগীর জানানয়, গত চার বছরে তাদের বিছানা, চাদর, বালিশের কভার, মশারি, শীতবস্ত্র কিছুই দেননি উপ তত্ত্বাবধায়ক। এমনকি খাবারের প্লেট-গ্লাস পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। পানি পান করতে হয় বোতলে। জগ-গ্লাস কেনা হয়নি।

নবম শ্রেণির মনির হোসেন জানায়, লোডশেডিং হলে অন্ধকারে থাকতে হয় তাদের। হারিকেন কিংবা মোমবাতির কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এসব বিষয়ে শিশু পরিবারের উপ তত্ত্বাবধায়ক ছাগলনাইয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আফতাব উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সরকারিভাবে আমরা যতটুকু বরাদ্দ শিশুদের জন্য পেয়ে থাকি ঠিক ততটুকু আমরা দেই। তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে করে বলেন, বরাদ্দ না দিলে আমরা শিশুদের দিব কিভাবে?
 
যোগাযোগ করা হলে ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শিশুদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫  
এমজেড/এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।