ঢাকা: প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে বিলুপ্তির পথে বাঘ। প্রতি বছর অব্যাহতভাবে কমছে বাঘের সংখ্যা।
২০০৪ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪শ’ ৪০টি। এর মধ্যে পুরুষ বাঘ ১শ’ ২১টি, বাঘিনী ২শ’ ৯৮টি ও শাবক ২১টি।
গত এক যুগের কিছু বেশি সময়ে দেশে বাঘ কমে দাঁড়িয়েছে ১শ’ ৬টি তে। অথচ ২০১০ সালেও বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের যৌথ জরিপে বাঘের সংখ্যা ৪শ’ থেকে ৪শ’ ৫০ উল্লেখ করা হয়। সে হিসেবে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা গত চার বছরে এক-চতুর্থাশ কমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও খাবারের ভিত্তিতে কমপক্ষে ২শ’ বাঘ থাকার কথা থাকলেও সেখানে বাঘ আছে মাত্র ১শ’ ৬টি। এভাবে কমতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর বাঘের অস্তিত্ব থাকবে কি-না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাঘের সংখ্যা কমে আসায় দুশ্চিন্তায় রয়েছে বন বিভাগও। কিভাবে বাঘ সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে গবেষণা চলছে।
গবেষকদের মতে, বাঘ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং শিকারীদের অপতৎপরতাসহ মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণ।
খাদ্য সংকটের কারণে প্রতি বছরই সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ থেকে বাঘ ভারতের অংশে চলে যাচ্ছে। বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৮১ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৫৩টি বাঘ হত্যার শিকার হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ৩টি, ১৯৮৬ সালে ২টি, ১৯৮৮ সালে ১টি, ১৯৯০ সালে ২টি, ১৯৯১ সালে ৪টি, ১৯৯২ সালে ১টি, ১৯৯৩ সালে ৪টি, ১৯৯৪ সালে ২টি, ১৯৯৬ সালে ৫টি, ১৯৯৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে ২টি, ১৯৯৯ সালে ৪টি, ২০০০ সালে ৫টি, ২০০১ সালে ১টি, ২০০২ সালে ৩টি, ২০০৪ সালে ৪টি, ২০০৫ সালে ৬টি, ২০০৭ সালে ৪টি, ২০১১ সালে ৪টি এবং ২০১২ সালে ১টি বাঘ শিকারীদের হাতে প্রাণ হারায়।
বন বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগে ২৪টি ও পূর্ব বিভাগে ১২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জে ১৪টি বাঘ গণপিটুনিতে মারা যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সুন্দরবনে ১২০টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে।
বনবিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ২৬ মার্চ শ্যামনগরের দাতনিখালী গ্রামে একটি বাঘ ঢুকে পড়লে এলাকাবাসী বাঘটিকে গুলি করে হত্যা করে। এর একদিন পর একই এলাকায় আরো একটি বাঘ গণপিটুনিতে মারা যায়।
এরপর ২০০৮ সালের ২০ জুন সন্ধ্যায় শ্যামনগরের দক্ষিণ কদমতলা গ্রামে একটি বাঘ প্রবেশ করে। এ সময় বাঘটির আক্রমণে এক গৃহবধূসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরো ২জন। এ ঘটনার পরদিন এলাকাবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে।
বাঘের সংখ্যাহ্রাস ও সংরক্ষণ নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলীর। তিনি জানান, বাঘের সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে একথা সত্য। তবে, বাঘ সংরক্ষণের জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান, অ্যাকশন টাইগার রিকভারি প্রোগ্রাম রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনে যেসব কর্মচারি কাজ করেন তাদের আইডি কার্ড প্রদান করা হবে। যারা বাইরে আছেন তাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা হবে। এছাড়াও বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি প্রতি দুই মাসে একটি করে সভা করবে। আমাদের গর্ব, জাতীয় পশু বাঘকে বাঁচাতে আমাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে। চোরা শিকারীদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
শুধু বাঘ বাঁচাতে নয়, দেশের গৌরবের প্রতীককে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে, বলেন প্রধান বন সংরক্ষক।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বাঘের সংখ্যা যেভাবে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, তাতে এক সময় বাঘ শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বাঘ হ্রাস পাওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর এখনই প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবনই টিকে থাকবে না। এছাড়া সুন্দরবন ও আশপাশের জেলাগুলোতেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এ অবস্থার মোকাবিলায় বাঘশিকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও করণীয় সব কিছু করতে হবে।
গত আগস্ট মাসে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে করণীয় ঠিক করতে বন বিভাগের পরামর্শ চাওয়া হয়।
এর আলোকে রোববার (৪ অক্টোবর) দেশি-বিদেশি বাঘ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দিনব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করছে বন বিভাগ। এখানে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ করা হবে। সেমিনারটি উদ্বোধন করবেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৫
এসএম/এসইউ