ময়মনসিংহ: মাথার খুলি, কয়েক জোড়া হাত, বুকের পাঁজর, পায়ের হাড় ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের টুকরো। বস্তায় ভরা কঙ্কাল কবর থেকে উঠিয়ে রাখা হয়েছিল জঙ্গলে।
ঘটনাটি সোমবারের (১২ অক্টোবর)। সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়ার তানপাড়া এলাকার। এমন ঘটনা দুই থেকে তিন মাস আগে ওই এলাকায় আরো বেশ কয়েকবারই ঘটেছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোর্শেদুল আলম জাহাঙ্গীরের মতে, ওই এলাকার ৪ থেকে ৫টি কবরস্থান থেকে গত ৩ মাসে চুরি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০টি কঙ্কাল।
এতো দিন কেউ হাতে নাতে ধরা না পড়ায় পার পেয়ে গেছে সংঘবদ্ধ কঙ্কাল চোররা। কিন্তু সোমবার আর শেষ রক্ষা হয়নি কঙ্কাল চোরের দলের।
এসব ঘটনায় মৃতদের স্বজনরা তাদের লাশ নিয়ে রয়েছেন চরম আতঙ্কে।
শুধু সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নেই নয়, অষ্টধর, পিয়ারপুর, বেগুনবাড়ি, বোরোরচর, পরানগঞ্জ ইউনিয়ন এবং মুক্তাগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গত কয়েক বছর ধরেই কবর থেকে লাশ উধাও হয়ে যাচ্ছে। আর এসব কঙ্কাল নিয়ে চলছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের (মমেক) অ্যানাটমি বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর কতিপয় কর্মচারী গড়ে তুলেছেন কঙ্কাল চুরির শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারাই নিজেদের লোক দিয়ে বিভিন্ন কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরি করিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে চড়া দামে বিক্রি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। নতুন শিক্ষার্থীদেরর জন্য প্রয়োজন কঙ্কাল। তাদের ভাষায় এ কঙ্কালকে বলা হয় ‘বোনস’। অনেক শিক্ষার্থী পুরনো কঙ্কাল দিয়ে কাজ সারলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নতুন কঙ্কাল কেনেন।
আর তাদের এ কঙ্কাল সরবরাহ করেন মেডিকেল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাই।
একাধিক সূত্রের দাবি, প্রায় এক যুগ ধরে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের চাহিদা অনুযায়ী, অবৈধভাবে কেনা অসংখ্য কঙ্কাল ঢুকেছে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। ওই চক্রটি এ সময়ে শত শত কঙ্কাল কেনাবেচা করেছে।
![](files/October2015/October13/Kongkal_mymensingh_Pic_3_970050277.jpg)
সূত্রমতে, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শাকিল ও ফজলুর নেতৃত্বে প্রথম কঙ্কাল চোর সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। পরবর্তীতে শাকিল পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলে হাসপাতালেরই আরেক কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাক, তার পুত্র সুমন ও নুরু এ বাণিজ্য নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেন।
এরপর শাকিল জামিনে বেরিয়ে এলে আবারো এ ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। দুই সিন্ডিকেটের মধ্যে গড়ে উঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে শাকিল চড়া দামে কঙ্কাল কিনতে শুরু করলে বিপাকে পড়ে প্রতিপক্ষ সিন্ডিকেট।
মাস দুয়েক আগে তাদের হামলার শিকার হন শাকিল। কঙ্কাল কেলেঙ্কারীর অন্যতম নায়ক শাকিল এ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা কামানোর পাশাপাশি নামে-বেনামে জমি-জিরাতেরও মালিক হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিন্ডিকেটের নির্দেশ অনুযায়ী, কবর থেকে লাশ চুরি করে আনতে পারলে মাঠ পর্যায়ের চোরেরা কঙ্কাল প্রতি পান ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। আর গরম পানিতে সিদ্ধ করে বা ক্যামিকেল দিয়ে লাশ থেকে মাংস ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর প্রতিটি কঙ্কাল বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায়।
ইদানিং আবার মাথার খুলি, হাত, বুকের পাঁজর, পায়ের হাড় ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের টুকরো আলাদা আলাদা দামে বিক্রি হয়। লাশের সঙ্কট দেখা দিলে আবার এ একটি কঙ্কালই বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকাতেও!
আরো জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে ময়মনসিংহে প্রথম আলোচনায় আসে কবর থেকে লাশ চুরির খবর। ওই সময় সদর উপজেলার খাগডহর ইউনিয়নের গণেশ্যামপুর গ্রামে একটি পাতিলে দুটি কঙ্কাল সেদ্ধ করার সময় এলাকাবাসী বাড়ি ঘেরাও করে আটক করে আবেদ আলী ও তার পুত্র শাহজাহানকে।
এরাই আগে কবর থেকে লাশ চুরি করে বিভিন্ন স্থানে পাচার করতো। এরপর এ সিন্ডিকেট কব্জায় নেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শাকিল ও ফজলু।
বছর দুয়েক আগে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানায় ওপেন হাউজ ডে এর অনুষ্ঠানে স্থানীয় অষ্টধর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কঙ্কাল চুরির ঘটনায় উদ্বেগ উৎকন্ঠার কথা তুলে ধরেন। এরপর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মঈনুল হকের নির্দেশে কঙ্কাল চোরদের ধরতে মাঠে নামে পুলিশ।
২০১৪ সালের ৪ জুলাই অষ্টধর ইউনিয়নের কোটোরাকান্দা এলাকা থেকে এরশাদ (২৪) নামে এক কঙ্কাল চোরকে আটক করা হয়। স্থানীয় বেগুনবাড়ি এলাকার একটি কবরস্থান থেকে ৩টি কঙ্কাল চুরি করে আনার পথে তিনি ধরা পড়েন। ওই সময় এরশাদ জানিয়েছিলেন, ওই এলাকার ভুট্টোর নেতৃত্বে ৭ জনের একটি চক্র এ কঙ্কাল চুরি করে আসছে।
একই বছরের আগস্টে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে সদরের অষ্টধার এলাকার সোহেল, লতিফ ও নিজাম নামে ৩ কঙ্কাল চোরকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই সময় তাদের ব্যাগে থাকা ৫টি কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।
ওই সময় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের দুই কর্মচারীর কাছে বিক্রি করার জন্য তারা কঙ্কালগুলো চুরি করে এনেছিল। এরপর কঙ্কাল চুরির ঘটনা আলোচনায় না এলেও সোমবার (১২ অক্টোবর) সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়ার তানপাড়া এলাকা থেকে উপ-পরিদর্শক (এস.আই) ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ কঙ্কালসহ দুই চোরকে আটকের পর কঙ্কাল চোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আবারো প্রকাশ্যে চলে আসে।
কঙ্কাল চুরির ঘটনার বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী শাকিলের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে একই ঘটনায় অপর সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে পরিচিত হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাককে জিজ্ঞাসা করলেই তিনি ক্ষেপে যান।
বলেন, শাকিলসহ কয়েকজন এ ব্যবসা করে। এরপর তার কাছ থেকে ফোন নিয়ে বিপ্লব বলে পরিচয় দিয়ে একজন দম্ভোক্তি করে বলেন, আমি কঙ্কাল বিক্রি করি। সব ম্যানেজ করেই এ কাম করি। আপনাদের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকরাও আমারে চিনে। আপনি লিখলেও কিছুই হবে না।
এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা: মতিউর রহমান বলেন, শাকিল ও ফজলু আগে এ ব্যবসা করতো। এখন তারা করে কী না বলতে পারবো না। তবে আরো কয়েকজন এ ব্যবসা করছেন বলে অনেকেই বলাবলি করেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
জানতে চাইলে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরির ঘটনায় কঙ্কালসহ জাহাঙ্গীর ও রমিজ নামে দুজনকে আটক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) তাদের আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে। একই সঙ্গে এ সিন্ডিকেটের প্রধান ও তাদের সঙ্গে কারা আছেন তা জিজ্ঞাসাবাদ করে বের করা হবে, বলেন ওসি কামরুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৫
জেডএম/