দাসিয়ারছড়া, কুড়িগ্রাম থেকে: আটষট্টি বছরে যা কল্পনা করতে পারিনি, একে একে তার সব ঘটে চলছে। কখনো ভাবিনি, আমরা নাগরিক স্বীকৃতি পাবো, এই ছিটমহলে বিদ্যুৎ আসবে, স্কুল হবে, ছেলে-মেয়েরা পড়তে পারবে, চিকিৎসা পাবে।
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার সত্তোরোর্ধ্ব বাসিন্দা আকতারুজ্জামান।
কথা বলতে বলতে আখতারুজ্জামানের চোখ বার বার জলে ছল ছল করে আসছিলো। তার কষ্ট, আবেগ চেহারায় ফুটে উঠছিলো।
তিনি বলেন, দাসিয়ারছড়া বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ছিটমহল ছিলো। কোনো দেশই আমাদের স্বীকৃতি দিতো না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারতো না, চাকরি করতে পারতো না। চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এখানেই আইন-বিচার কিছুই ছিলো না। সব নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
বুধবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় আখতারুজ্জামানের।
গত ৩১ জুলাই ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা সীমান্তচুক্তি কার্যকর করা হয়। ওইদিন রাতে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল হস্তান্তরের মাধ্যমে ৬৮ বছরের সমস্যার সমাধান হয়। ছিটমহলের মানুষগুলো ফিরে পান নাগরিক স্বীকৃতি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার এবং নাগরিক সুবিধা।
দাসিয়ারছড়া এ ছিটমহলগুলোর মধ্যে একটি।
বেলা ১১টার দিকে দাসিয়ারছড়া পৌঁছানোর পর চোখে পড়ে বদলে যাওয়ার চিত্র। দ্রুতই বদলে যাচ্ছে এখানকার মানুষের ভাগ্য, জীবন-মান। ক্ষেতের আইলের মতো চিকন রাস্তা প্রশস্ত রাস্তায় পরিণত হচ্ছে। কাঁচা রাস্তার পরিবর্তে হচ্ছে পাকা রাস্তা। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্যুতের আলো।
দাসিয়ারছড়ার কামালপুর, বড় কামাত, ছোট কামাত, বালাটারি, বোটের হাট, রাসমেলা, বটতলা, দেবিরপাট- এ নয়টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে এখানকার মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। নাগরিক স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সরকারের নানা উন্নয়ন উদ্যোগের ফলে নতুন স্বপ্ন দেখছেন মানুষ। নতুন উদ্যমে পথ চলতে শুরু করেছেন তারা।
গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে এখানকার মেঠোপথ, সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। এখানকার অপরূপ গ্রাম্য প্রকৃতির এই সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলোই ৬৮ বছর ছিটমহলের কারণে সকল নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত আত্মপরিচয়হীন জীবন কাটিয়েছিলেন।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের আড়াই মাসের মধ্যে দাসিয়ারছড়া ছিটমহলবাসী নানা নাগরিক সেবা পেতে শুরু করেছেন।
এলাকাবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে গত ২ আগস্ট দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এখানে একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
৬শ’ ৪৩টি বিদ্যুতের লাইন সংযোগ দিয়েছে স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুধী সমাবেশে যোগদান করে এ বিদ্যুৎ সংযোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দাসিয়ারছড়ার প্রতিটি ঘরকে বিদ্যুতায়ন করা হবে। সে লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব মামুন অর রশিদ।
দাসিয়ারছড়ার বালাটারি, রাশমেলা, সমন্বয় মধ্যটারি- এ তিনটি গ্রামে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। এখানে ইউনিয়ন কমপ্লেক্সের সঙ্গে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
ফুলবাড়ি-নাগেশ্বরী সড়কের গঙ্গারহাট বাজার থেকে দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে।
দাসিয়ারছড়ায় তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় বাস্তবায়নের পর বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় ১০-১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন স্থানীয়রা।
২১ আগস্ট কালিরহাটে একটি ডিজিটাল সাব সেন্টার উদ্বোধন করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর একটি মেডিকেল টিমের মাধ্যমে তিন হাজার নারী-পুরুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, সাড়ে ৩৩ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে দাসিয়ারছড়ায় ৩২টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। সরকারের বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে- ইউনিয়ন পরিষদ নির্মাণ, পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা, গভীর নলকূপ স্থাপন, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন। এছাড়া সেখানে দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক নিরাপত্তার নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।
আনসার ও ভিডিপি বিভাগ ইতোমধ্যে ৬৪ জন দাসিয়াছড়াবাসীকে মৌলিক ভিডিপি প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ভ্রাম্যমাণ ল্যাবের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন যুবক ও যুব মহিলারা। যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে চলতি মাসেই আরও ২৪ জন বেকার যুবক ও যুব মহিলাকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা কামাল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার রাস্তাগুলো অনেকটা ক্ষেতের আইলের মতো। সেখানে আজ পাকা রাস্তা হচ্ছে। বিদ্যুৎ আসছে।
তিনি বলেন, জুলাই মাসে চুক্তি কার্যকরের পর থেকে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রতিদিনই যেন বদলে যাচ্ছে আমাদের এ এলাকা।
কামাল বলেন, একটা ঠিকানা হওয়ায় এখানকার মানুষগুলো বুকে সাহস ফিরে পেয়েছেন। কাজে উদ্যোম ফিরে পেয়েছেন। শুধু সরকারি পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেরাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে এজন্য সরকারের সহযোগিতা অব্যহত রাখার পাশাপাশি ধীরে ধীরে তা আরো বাড়ালেই আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারবো।
ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় এতোদিন আমাকে ভুয়া পরিচয় দিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এখন আর তা করতে হবে না। এখন আমরাও বাংলাদেশের নাগরিক। বুকে সাহস নিয়ে চলতে পারবো।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫
এমইউএম/এএসআর
** প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কাঁচা হাতের কবিতা