বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ নারীই কুটির শিল্প, মাছ শিকার ও কৃষি কাজ করে। সে হিসেবে জীবনমুখী অর্থনীতির অনেকটাই ধারক গ্রামীণ নারী।
উপকূলীয় প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসেঃ ইচ্ছা, শক্তি, আত্মবিশ্বাস আর প্রচেষ্টার সমন্বয় ঘটলে যে দারিদ্র্য জয় করা সম্ভব সেটি প্রমাণ করে দিয়েছেন প্রান্তিক নারী কৃষক পারুল বেগম। গৃহস্থালির কাজ শেষ করেও যে কৃষি কাজ করে সফলতা অর্জন করা যায় তার উদাহরণ এখন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার প্রান্তিক নারীরা। পুরুষের পাশাপাশি নারী কৃষকরাও এগিয়ে যাচ্ছেন কৃষি কাজে।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রায়হানপুর ইউনিয়নের গুদিঘাটা গ্রামের হানিফ হাওলাদারের স্ত্রী পারুল বেগম কৃষি বান্ধব নারী হিসেবে নীরবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। তিনি বসতবাড়ির আঙিনা ও পুকুর পাড়জুড়ে নানা মৌসুমি সবজি আর পুকুর ভরা মাছের আবাদ করেছেন। সেইসঙ্গে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি প্রতিপালন করে তিনি এখন স্বাবলম্বী।
পারুলের বাড়ি দৃশ্যত এক খামারবাড়ি। নিভৃত পল্লীতে স্বশিক্ষিত পারুল এক সফল কৃষাণি উদ্যোক্তা, যা গাঁয়ের যে কোনো সাধারণ নারীর জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ১৮ বছর আগে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বড় গুদিঘাটা গ্রামের মরহুম সিকান্দার আলীর ছেলে হানিফ হাওলাদারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় পারুল বেগমের। বিয়ের পর কয়েক বছর স্বামীর সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে থাকলেও সংসার জীবনে সুখ ছিল তার। এভাবে কাটে বছর পাঁচেক। সন্তানধারণে অক্ষম পারুল অনেক ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ দেখিয়ে কোনো ফল পাননি। দুঃখী পারুল বন্ধ্যা নারীর অপবাদ মাথায় নিয়ে নীরবে কাঁদেন। শ্বশুরালয়ে এ অপবাদ সইতে না পেরে ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। বছর খানেক পরে বাড়ি এলে পারুলের মা ফাতিমা বেগম তাকে ২০ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দেন।
চাকরির কিছু উপার্জনকে সম্বল করে সেই জমিতে মাথা গোঁজার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন। নিজ হাতে মাটি কেটে পুকুর ও সবজির ক্ষেত তৈরি করেন তিনি। কোনো ধরনের সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা না নিয়েই তিনি প্রথমে তার উপার্জনের ৩০ হাজার টাকা দিয়ে চিংড়িসহ দেশীয় প্রজাতির মাছের চাষ শুরু করেন আর পুকুরের পাড়ে রোপণ করেন নানা ধরনের সবজি। প্রথমবারে মাছ আর সবজি বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা লাভ হয় তার। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্বামী হানিফ হাওলাদার এখন তার কাছেই থাকেন। হানিফ কৃষিকাজের পাশাপাশি মেশিন মেকানিকের কাজ করেন। আর পারুল হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার দেওয়াসহ সবজি ক্ষেতের সব কাজ একাই করেন। বাড়ির চারপাশজুড়ে চলতি মৌসুমে শিম, বরবটি, কপি, লাউ, করলা, কুমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজির আবাদ করেছেন তিনি।
এছাড়াও পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি পারুল তিনটি গাভী, ১৭টি দেশি হাঁস, ১৮টি রাজহাঁস ও ২৪টি মুরগি পালন করছেন। সবজি ক্ষেতের পরিচর্যা, হাঁস-মুরগি পালন করে সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থেকে সন্তানের অভাব ভোলার চেষ্টা করেন পারুল। অভাব নামের শব্দটি এখন তাদের জীবনে নেই বললেই চলে। শুধু পারুল বেগম নয়, ওই গ্রামের বানেছা বেগম, শেফালী বেগমসহ অসংখ্য প্রান্তিক নারী আজ কৃষি কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
পারুল বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে এখন স্বাবলম্বী। আমি দারিদ্রের কাছে হার মানিনি। ইচ্ছা আর শক্তি থাকলে যে স্বাবলম্বী হওয়া যায় তা আজ আমি বুঝতে পেরেছি।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আলতাফ হায়দার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নারী নেত্রী মুনিরা ইয়াসমিন খুশি বাংলানিউজকে বলেন, নারীরা এখন অবলা বা অহবেলার পাত্র নয়। তারা ইচ্ছে করলে সবকিছুই পারে পারুল বেগম সেটিই প্রমাণ করে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ঋণের সহায়তা পেলে এই প্রান্তিক নারীরা আরও উদ্যোগী হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৫
আরএ
** ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত ‘কানন বালারা’