খুলনা: ধান ও ঘাসের ডগায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে হেমন্ত।
শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকালকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। হেমন্তের এই মৌনতাকে ছাপিয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে, মানুষের জীবনে এনে দেয় সার্বজনীন উৎসবের ছোঁয়া। নবান্ন মানেই চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এই ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে হেমন্তের এ শাশ্বত রূপ চিরকালীন।
নগরজীবন থেকে আর সব ঋতুর মতো হেমন্তও হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস না হলে ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে দেখুন, আজ শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) পহেলা কার্তিক, হেমন্তের শুরু। অথচ শহুরে রোদে চাঁপা ফুলের রং ধরেনি বরং ধুলো আর ধোঁয়ায় মলিন।
শীতের পূর্বাভাস:
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস মিলে ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। কৃত্তিকা ও আর্দ্রা এ দুটি তারার নাম অনুসারে মাস দুটির নাম রাখা হয় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘মরা’ কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মওসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কবিদের চোখে হেমন্ত:
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। /ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে। ’ _ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ। /‘বিন্নি পলাশ’ চালের ফিরনি/ তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত। /শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত। ¬_ কাজী নজরুল ইসলাম।
প্রথম ফসল গেছে ঘরে,/হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে/বাঁশ-পাতা মরা ঘাস আকাশের তারা!/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা! _ জীবনানন্দ দাশ।
সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে? _ সুফিয়া কামাল।
পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ:
ধান পেকে মাঠের পর মাঠ যেন সোনালী-হলুদ রঙে সেজে উঠেছে। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। সেই সাথে গ্রামগুলি হয়ে উঠছে স্বর্ণভাণ্ডার আর শষ্য ভাণ্ডার। কৃষকের মুখে দেখা দিচ্ছে এক অনাবিল সুখের হাসি।
নবান্ন:
গ্রামবাংলার মাঠে-খেতে চলছে আমন ধান কাটার মহোৎসব নবান্ন। যা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। গ্রামীণ একটি বচন আছে- ‘ঠেলা যায় হাত্তিকে. ঠেলা যায় না কার্তিককে’। কৃষকের ঘরে এই সময় ফসলের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় নানান অভাব, একটি হাতি ঠেলে নেওয়া কঠিন হলেও আরও ভয়াবহ অভাবের মাস কার্তিক মাসকে মোকাবেলা করা, কিন্তু আড়ালে চলে মাঠে ক্ষেতে ফসল উৎপাদনের আয়োজন আর যা সুখের আর আনান্দের মুখ দেখায় নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।
আসছে অতিথি পাখি:
হেমন্তের আবহাওয়া বলে দেয় শীতকাল আসন্ন। প্রাণিজগতেও তার বার্তা মিলছে। আর যে কারণে শীত বা তুষার প্রবণ অঞ্চল থেকে দল বেঁধে ছুটে আসতে শুরু করছে শীতের অতিথি পাখি কিছুটা উষ্ণতার আশায়। হেমন্তের অতিথি হয়ে শীতের পরিযায়ী ছোট-বড় পাখিরাও তাদের শীতকালীন আশ্রয় খুঁজে নিতে আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ছোট-বড় বিল-জলাশয় আর দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরে।
শুধুই অনুভবের:
হেমন্তকালের প্রকৃতি আষাঢ়-শ্রাবণ কিংবা ভাদ্র মাসের মতো বৃষ্টি হবার কথা নয়, কারো মন মন্দির স্যাঁতস্যাঁতে থাকার কথা নয়। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-বন বাদাড়। সৃষ্টির সকল জীবের মাঝে মাঝে দেখা মেলে চঞ্চলতা, সখা-সখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে আকাশ-বাতাস-প্রান্তর। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত তীব্র, প্রখর অথবা মুখরা নয়, তাই হেমন্তকে আলাদা করে দেখা যায় না, ম্লান, ধুসরিত আর অস্পষ্ট হেমন্তকাল শুধু অনুভবের। বসন্তের তীব্র ফুলের গন্ধ, পাখির গান অথবা গ্রীষ্মের খরতাপ, বৈশাখী ঝড় কিংবা বর্ষার ভরা নদী নালা, ঘনঘোর বরষায় দিনব্যাপী ঝমঝম বৃষ্টির মতো করে হেমন্ত জানান দেয় না আমি আছি, আমি এসেছি।
হেমন্তের প্রকৃতি:
নতুন ফসল ঘরে তুলে নতুন বছর শুরু করার নিমিত্তেই এক সময় বাংলা বছর শুরু হতো হেমন্ত কাল দিয়ে, সম্রাট আকবর ও তার প্রবর্তিত বাংলা সাল শুরু করেছিলেন অগ্রাহায়ণ দিয়ে।
সকালের সোনারঙা রোদ বাড়িয়ে দেয় বাংলার পথঘাট আর মাঠের উজ্জ্বলতা, গ্রামের মাঠে যতদূর চোখ যায় সোনালি ধান। লাউয়ের মাচায় যৌবনবতী তরুণীর মতো লিকলিকে প্রতিটি ডগার খিলখিল হাসি, হাওড়-বিলে অতিথি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। কুয়াশার ধূসর চাদর গায়ে হুট করে এক ভোরে দোরে হানা দেয় কমনীয় শীত। বাউলেরা রঙিন পোশাকে গান গেয়ে বেড়ায়। জুঁই, গোলাপ, শাপলা, বাগানবিলাস সহ অনেক ফুলের ভেতর দিয়ে প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পায়। এ সময়ের নির্মল বাতাস প্রকৃতিকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
গান, কবিতায় কত রং রূপেই না ধরা দেয় হেমন্ত। তবে হেমন্ত শুধু হেমন্ত নয়, হেমন্ত মানে শীতের আগমনী বার্তা। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে, ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। শহরে অতটা টের পাওয়া না গেলেও, গ্রামে খুব চোখে পড়ে প্রকৃতির এ বদলে যাওয়া। গাছীরা এখন খেজুর গাছ পরিষ্কার করার কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রামবাংলার এই চিরচেনা রূপ হেমন্তের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ/