ঢাকা: মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের একাত্তরের কৃতকর্মের চূড়ান্ত দণ্ড নির্ধারণ ও কার্যকরের তোড়জোরের মধ্যেই চলছে অপর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রক্রিয়া।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সূত্রমতে, মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের কার্যক্রম শেষের দিকে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরদিন ০১ অক্টোবর কারাগারের কনডেম সেলে বসে নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানা শোনেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী। এখন আইনি লড়াইয়ের সর্বশেষ ধাপ ১৪ অক্টোবর করা রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছেন তারা। ওই রিভিউ আবেদন নাকচ হওয়া সাপেক্ষে ফাঁসির দড়িও ঝুলছে তাদের অপেক্ষায়।
আপিল মামলার চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে আমৃত্যু কারাবাস পাওয়া সাঈদীকেও রিভিউ আবেদন করে সর্বোচ্চ সাজার মুখোমুখি করতে চান রাষ্ট্রপক্ষ। এ লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ফাঁসির দণ্ডাদেশ পুনর্বহালের আরজি জানাবেন বলে জানিয়ে রেখেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আইন নির্ধারিত ১৫ দিনের মধ্যেই সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে রিভিউ আবেদন করবেন।
অন্যদিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি ও খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করবেন সাঈদীও। সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী জানান, তারা রিভিউ করবেন খালাস চেয়ে।
ফলে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে যেমন আপিল করেছিলেন রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষ, ঠিক তেমনি দুই পক্ষই প্রস্তুত হচ্ছেন আপিল মামলার রায়েরও রিভিউ আবেদন করতে। মুজাহিদ-সাকার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল বা রিভিউ করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। আপিল মামলার সংক্ষিপ্ত ওই রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। অন্য চার বিচারপতি হচ্ছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
রায় দেওয়া পাঁচজনের মধ্যে দুই বিচারপতি ইতোমধ্যে অবসরও নিয়েছেন।
রায় পর্যালোচনায় জানা গেছে, বিচারপতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাবাস দেন সাঈদীকে। এর মধ্যে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্যদিকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন।
ট্রাইব্যুনাল থেকে আপিল বিভাগে আসা ১৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার মধ্যে পাঁচটির চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। সেগুলোর মধ্যে চারটির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত অন্য দু’টি পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসারে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
আগামী ৩ নভেম্বর ষষ্ঠ হিসেবে অপর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
আর অন্য সাতটির শুনানি শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার জব্বার পলাতক থাকায় তিনি আপিল না করলেও তার সর্বোচ্চ সাজার আরজি জানিয়ে আপিল করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে মীর কাসেম, মোবারক, আজহার, সৈয়দ কায়সার, সুবহান এবং মাহিদুর-আফসার আপিল করেন স্ব স্ব মামলার সাজার বিরুদ্ধে।
বাকি দু’টি আপিল শুনানি অকার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির সাবেক নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম মৃত্যুবরণ করায় তাদের আপিল আবেদনের ওপর শুনানি হবে না।
সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১শ’ থেকে ১শ’৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার মত ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছিলো ট্রাইব্যুনালে।
এ ২০টি অভিযোগের মধ্যে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৫টি অভিযোগ। এর মধ্যে দু’টিতে অর্থাৎ ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে আমৃত্যু, একটিতে অর্থাৎ ১০ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন, একটিতে অর্থাৎ ৮ নম্বর অভিযোগে ১২ বছর ও একটিতে অর্থাৎ ৭ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে সাঈদীকে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সে রায়ে তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দু’টি অপরাধে অর্থাৎ ৮ ও ১০নং অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত অন্য ৬টি অর্থাৎ ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগে আলাদাভাবে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দু’টি আপিল (আপিল নম্বর: ৩৯ ও ৪০) দাখিল করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ৬টি অভিযোগে শাস্তির আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর সাঈদীর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন আসামিপক্ষ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৫
ইএস/এএসআর