ফেনী: একটা সময় জহির রায়হান মিলনায়তনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো ফেনীর শিল্প-সাহিত্য চর্চা। এই ভবনকে ঘিরে অহর্নিশ ফেনীর সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমীদের নাটক, আবৃত্তি, গান আর নৃত্যের মাতামাতি ছিল।
সময়ের পরিক্রমায় জহির রায়হান মিলনায়তনের আরো বেশি আধুনিকায়নের কথা থাকলেও হয়েছে উল্টোটা। রীতিমতো নাই হয়ে গেছে জেলার শীর্ষ সাহিত্য-সংস্কৃতির এ প্রাণকেন্দ্র।
প্রায় ৭ বছর আগে আধুনিক ভবন নির্মাণের অজুহাতে হলটি ভেঙে ফেলা হয়। পরে নতুন করে আর নির্মাণ করা হয়নি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নামে শহরের মিজান রোডের ‘শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন’।
স্থানটি এখন পরিণত হয়েছে গো চারণ ভূমিতে। সারাদিন হলের মাঠের জায়গায় চড়ছে স্থানীয়দের গরু-ছাগল। এতে জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র হতাশা।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠকরা বার বার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দপ্তরে কড়া নাড়লেও তাদের আবেদনে সাড়া মেলেনি। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে উপেক্ষিত রয়ে গেছে তাদের প্রাণের দাবি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন ভবনটি জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। শহরের কেন্দ্রস্থল মিজান রোডে প্রায় ৩ যুগেরও বেশি সময় এই মিলনায়তনই ছিল জেলার সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।
আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলে ফেনী জেলা পরিষদ প্রায় ৭ বছর আগে ভবনটি ভেঙে ফেলে। এরপর থেকে পুনঃনির্মাণকাজ শুরু করা দূরের কথা, ভবনের নকশাই অনুমোদন হয়নি।
জেলার সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তনকে ঘিরে নিয়মিত নাট্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মহড়া। ভবন ভেঙে ফেলায় এসব সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কার্যালয় ও মহড়া কক্ষের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে জেলার সাংস্কৃতিক চর্চা। ফলে ফেনী অনেকটাই হারাতে বসেছে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
তারা জানান, মিলনায়তনকে ঘিরে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলত সাংস্কৃতিক চর্চা। ভবনটি না থাকায় সেটা একখণ্ড মাঠে পরিণত হয়েছে। ফলে স্থানীয়রা এখন নিয়মিত সেখানে গরু চড়ান।
ফেনী জেলা পরিষদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষাটের দশকের শেষদিকে ফেনী মহকুমা শহরের কেন্দ্রস্থল মিজান রোডের জেলা পরিষদ ভবনের সামনে ৪৩ শতাংশ জমিতে নির্মিত হয় ফেনী টাউন হল। ৪০০ আসনের মিলনায়তনটিতে সাংস্কৃতিক চর্চা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হতো। মিলনায়তনের একপাশে ও ছাদে ১০টি পৃথক কক্ষ ছিল। এসব কক্ষে এক সময় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা গণগ্রন্থাগার ও রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রম চলতো। পরে ফেনী পৌর কর্তৃপক্ষ কক্ষগুলো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বরাদ্দ দেয়।
তারা জানান, ওই ভবনের জমিটি জেলা পরিষদের মালিকানাধীন ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসন ভবনটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় ফেনী পৌরসভাকে। কিন্তু জমির মালিকানা হস্তান্তর করা হয়নি। আশির দশকের শুরুতে ফেনী টাউন হলের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন’ করা হয়। তখন থেকে মিলনায়তনের কক্ষগুলো নামমাত্র ভাড়ায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০০৮ সালের শেষদিকে জেলা পরিষদ মিলনায়তনটি ভেঙে সেখানে অধিক আসনের একটি আধুনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি পুনঃনির্মাণের জন্য এডিবি থেকে দেড় কোটি টাকার প্রাথমিক বরাদ্দ হয়। কিন্তু নতুন ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় জেলা পরিষদ গত ৭ বছরেও কাজ শুরু করতে পারেনি।
সমন্বতি সাংস্কৃতিক সংসদ ফেনী জেলা শাখার সভাপতি মাহবুব আল তমাস বাংলানিউজকে বলেন, মিলনায়তনটি ভেঙে ফেলায় ফেনীর শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। চর্চার অভাবে দিনদিন কর্মী কমতে শুরু করেছে।
ফেনীর আর্য্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সমর দেবনাথ বলেন, হলটি নির্মাণ করা হলে এ জেলার সংস্কৃতি চর্চা প্রাণ ফিরে পাবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী জেলা পরিষদের প্রশাসক আজিজ আহম্মদ চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফেনী জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে আয়োজিত ভিডিও কনফারেন্সে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভবনের জন্য দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। নতুন বরাদ্দ ও নকশা পেলেই কাজ শুরু করা যাবে।
ফেনীর শিল্প-সাহিত্যকর্মীদের দাবি, দ্রুত ভবনটি নির্মাণ করা হোক। এর মাধ্যমেই আবার মুখরিত হবে ফেনীর শিল্প-সাহিত্যাঙ্গন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৫
এসআর