ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

‘রাত আমাদের জন্য না’

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৫
‘রাত আমাদের জন্য না’ ছবি : দীপু মালাকার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: রাত ৩টা। নগরীরবাসী যখন গভীর ঘুমে, তখন শহর পরিস্কারে ব্যস্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।

ছুটে চলা গাড়ির চলাচলের ফাঁকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাড়ু দিয়ে চলেছেন মনোয়ারা বেগম (৪০)। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হওয়ায় সমাজের অনেক সুযোগ সুবিধা থেকেই বঞ্চিত মনোয়ারা বেগমরা।

সোমবার (০২ নভেম্বর) দিনগত রাত ৩টার দিকে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের এমইএস এলাকার রাস্তা পরিস্কারের সময় বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় মনোয়ারা বেগম ও তার সঙ্গীদের। জানান তাদের সংগ্রামী জীবনের কথা।

মনোয়ারা বলেন, গত ৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। ভাল লাগে না, তারপরেও করতে হয়। ঘরে এক ছেলে ও মেয়ে আছে। স্বামী নাই, কাজ না করলে খাবার জোটে না। তাই মন না চাইলেও করতে হবে। রাতে সবাই ঘুমালেও আমরা পারি না। রাত তো আমাদের জন্য না।

তিনি জানান, রাতে রাস্তায় কাজ করার সময় ট্রাক আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি চেপে ধরে। কখন না আবার একটি ট্রাক চাপা দিয়ে চলে যায়। চোখের সামনে কয়েক জনের ট্রাক চাপা দিতে দেখেছেন তিনি। তবু কোনো উপায় নেই। পেটের টানে ভয়কে উপেক্ষা করে ঝাড়ু হাতে রাজপথে নামতে হয় মনোয়ারা বেগমকে।

এই কাজ ভালো লাগে না, সড়কে কাজ করার সময় ভয় লাগে, তবু কেন এ পেশাতেই থাকা, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তার জবাব, অন্য কোথাও আমাদের কাজে নেয় না।

ছেলে-মেয়ের মুখে হাসিফুটাতে রাতদিন সমান তালে কাজ করেন বলে জানালেন মনোয়ারা বেগম। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যমুনা ফিউচার পার্কে কাজ করেন। এরপর রাত ১২টা থেকে শুরু হয় রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ, চলে সকাল অবধি।  

রাস্তা ঝুড়ু দিয়ে পান তিন হাজার টাকা, আর যমুরা ফিউচার পার্ক থেকে পান সাত হাজার টাকা। এই টাকায় চলে সন্তানদের মুখের খাবার ও ঘরভাড়া।

তার সঙ্গেই ঝাড়ু হাতে কাজ করছেন জুবেদা বেগম (৪৫)। সড়কে ঝাড়ু দিতে গিয়ে প্রাণ দিতে দেখেছেন তিনি নিজের বোনকে। তারপরেও কাজ ছাড়তে পারেনি। অভাবের তাড়না আর অন্য কোথাও কাজের সুযোগ না মেলায় এ পেশাতেই থাকতে হচ্ছে তাকে।

জুবেদা জানান, রাতে চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন গাড়ি চালানোর সময়। বিশেষ করে ট্রাক চালকরা কিছুই মানতে চান না।

সরেজমিনে দেখা গেল, রাস্তায় দূরন্ত গতিতে ছুটছে ট্রাক, প্রাইভেটকার, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন। এর মধ্যেই রাস্তার মাঝের আইল্যান্ড পরিস্কার করছেন জুবেদা, মনোয়ারা। তাদের জন্য কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নেই। এভাবেই প্রতি রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।

মধ্যরাত হতে ভোর অবধি চলে তাদের কাজ। সকাল হবার আগেই সড়ক পরিচ্ছন্ন থাকা চাই, তা না হলে বেতন কাটার ভয়। আবার এ পেশ‍ার কারণে ছেলেমেয়েদেরও ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেলে না পড়ার সুযোগ।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী আশরাফ আলী (৫০) জানালেন, মেয়েদের স্কুলে পড়াতে পারেননি তিনি। নাই। দুই মেয়েরই বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে-জামাইও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হওয়ায় ছেলেমেয়েদের অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারেন না। পারেন না ভালো মানের কোনো স্কুলে সন্তানকে পড়তে দিয়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন সত্যি করতে।

তিনি বলেন, অসুস্থ হলেও ছাড় নেই তাদের জন্য। অনুপস্থিতি মানেই বেতন কাটা। একদিন কাজ করার সময় আমার কাছের একজনকে যখন ট্রাক চাপা দিয়ে চলে গেল, তখন মনে হয়েছিল এই বুঝি জীবন শেষ। জীবনই আছিল না।

আশরাফ আলী বলেন, শীতের সময় কাঁপতে কাঁপতে কাজ করতে হয়। টাকা নাই যে শীতের পোশাক কিনবো। যা থাকে তা পরেই চলে আসি।

রাতে কাজ করতে খারাপ লাগে কি না, জানতে চাইলে বলেন, রাত আমাদের জন্য না।

সারা দিনের কর্মচঞ্চল নগরীর সড়কে ধুলোবালির আস্তর পড়ে থাকে, সকাল হলেই দেখা যায় সড়ক পরিস্কার পরিপার্টি। নগরবাসীর সবাই জানে, নগরীর নির্মল সকালের পেছনে রয়েছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদেরও ভূমিকা। কিন্তু সেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কি পরিমাণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, তা অনেকেরই অজানা।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৫
এসএম/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।