ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

উপকূলে আতঙ্কের মাস নভেম্বর!

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
উপকূলে আতঙ্কের মাস নভেম্বর! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

বরগুনা: বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলের বিস্তির্ণ জনপদ। ১৭৯৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর শুধু নভেম্বর মাসে ১১টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে।

যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি, গৃহপালিত ও বন্য পশুর মৃত্যু ও সম্পদ হানি ঘটে। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর আলাদা একটি আতঙ্কের মাস।

চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি নিম্নচাপের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির নিয়মিত বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।

ঢাকায় আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক, চেয়ারম্যান ও বিশেষজ্ঞ কমিটি শাহ আলমের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, নভেম্বর মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হতে পারে ২-৩টি নিম্নচাপ। এর মধ্যে ১-২টি নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং এ মাসের শেষ সপ্তাহে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নিচে থাকতে পারে। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। দেশের দৈনিক গড় বাষ্পীভবন ২ দশমিক ৭৫ থেকে ৩ দশমিক ৭৫ মিলিমিটার এবং গড় সূর্য কিরণকাল ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা থাকতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (সিডিএমপি) দুর্যোগ কোষ থেকে বিগত বছরগুলোর শুধু নভেম্বর মাসের সংগঠিত ঘূর্ণিঝড় গুলো হচ্ছে, ১৭৯৭ সালে নভেম্বর মাসে তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায়। সাধারণ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে যায় এবং চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি জাহাজ নিমজ্জিত হয়। ১৯০৪ সালের নভেম্বরে সোনাদিয়ার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু এবং বহু মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়।

১৯৭০ সালের ১২-১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণ ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচণ্ড বাতাস দু’দিন ধরে বার বার আঘাত হানে চট্টগ্রামে এবং সেই সঙ্গে বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহান উদ্দিনের উত্তরাঞ্চল, চর তজিমুদ্দিন, মাইজদির দক্ষিণাঞ্চল ও হরিণাঘাটায়।

স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক এই ঘূর্ণিঝড়ে জীবন, সম্পদ ও ফসলের ধ্বংস সাধন হয়। সরকারি হিসেবে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিলো এবং ৩৮ হাজার সমুদ্র নির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭৭ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এর মধ্যে ৪৬ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী ঘূর্ণিঝড় চলাকালে মাছ ধরার সময় মৃত্যু বরণ করে। মোট ২০ হাজার এর অধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণও ছিলো অনেক। ১০ লাখের ও অধিক গবাদি পশুর মৃত্যু হয়, চার লাখ ঘরবাড়ি এবং ৩ হাজার ৫শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৭০ সালের এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিলো প্রায় ১০.৬ মি.। সমুদ্রে ভরা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংগঠিত হওয়ায় এমন প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিলো।

১৯৭১ সালের ৫-৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের উপকূলবর্তি অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে (ক্ষয় ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি)।

১৯৭১ সালের ২৮-৩০ নভেম্বর সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৭-১১৩ কি.মি. বায়ু প্রবাহ ও ১ মি. কম উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসসহ ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়। সমগ্র খুলনা অঞ্চলে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করে এবং খুলনা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

১৯৭৪ সালের ২৪-২৮ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তি দ্বীপ সমূহে ঘণ্টায় ১৬১ কি.মি. বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও ২.৮-৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। প্রায় ২শ মানুষ ও ১ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয় এবং ২ হাজার ৩শ ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়।

১৯৮৩ সালের ৫-৬ নভেম্বর ঘণ্টায় ১৩৬ কি.মি. বেগে বায়ু প্রবাহ ও ১.৫২ মি. উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়ার সন্নিকটস্থ কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিম্নাঞ্চল, টেকনাফ, উখিয়া, ময়িপং, সোনাদিয়া, বরিশাল ও পটুয়াখালীর উপর দিয়ে বয়ে যায়। ৫০টি নৌকাসহ তিনশো মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয় এবং দুই হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।

১৯৮৬ সালের ৮-৯ নভেম্বর উপকূলবর্তি দ্বীপ সমূহ এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়। বাতাসের গতিবেগ ছিলো প্রতিঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কি.মি. এবং খুলনায় ৯০ কি.মি.। এতে ১৪ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৭ হাজার ২শ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।

১৯৮৮ সালের ২৪-৩০ নভেম্বর যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, উপকূলবর্তি দ্বীপসমূহ এবং খুলনা বরিশালের চরাঞ্চলের উপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কি.মি. বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মংলায় চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে ৫ হাজার ৭০৮ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৬৫ হাজার গবাদি পশু মারা যায়। বহু সংখ্যক বন্য পশু মারা যায়। তার মধ্যে ছিলো হরিণ ১৫ হাজার ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯টি এবং ফসল বিনষ্ট হয় প্রায় ৯৪১ কোটি টাকার।

১৯৯৫ সালের ২১-২৫ নভেম্বর উপকূলবর্তি দ্বীপ সমূহে এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কি.মি. বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যু ও ১৭ হাজার গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হানে। বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলা এই সাইক্লোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অন্যন্য জেলাগুলো হচ্ছে, ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, শরিতপুর, বরিশাল ও ভোলা।

সরকারি হিসাবে সাইক্লোন সিডরের কারণে ৩ হাজার ৪০৬ জন লোক নিহত হয়, নিখোঁজ হয় ১ হাজার ৩জন, মারাত্মক আহত হয় ৫৫ হাজার । তবে বে-সরকারি হিসাবে এ সংখ্য আরো বেশি।

দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করছে উন্নয়ন সংগঠন ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন অফ কোস্টাল এরিয়াস পিপল‘স (ডোক্যাপ)।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মাসুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, বিগত বছরগুলোর ঘূর্ণিঝড়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উপকূলবাসীর জন্য নভেম্বর একটি আতঙ্কের মাস। কেননা দেশের ইতিহাসে সব বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এই নভেম্বর মাসেই সংগঠিত হয়।

তিনি আরো বলেন, সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ দুর্যোগ মোকাবেলায় ও ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।