ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

তেল কয়লায় একাকার সুন্দরবন

ইনজামামুল হক, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
তেল কয়লায় একাকার সুন্দরবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

বাগেরহাট: তেলবাহী ট্যাংকারের পর সুন্দরবনের কাছে এবার প্রায় ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ডুবলো কার্গো। সুন্দরবনের কাছে কয়লা ভিত্তিক রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধীতা চলমান থাকা অবস্থায় কয়লাবোঝাই কার্গোডুবির এ ঘটনায় নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।



দুর্ঘটনার সাত দিন পেরিয়ে গেলেও কায়লাবোঝাই ওই কার্গোটি উদ্ধার কাজ শুরু হয় নি। কখন উদ্ধার হবে, নাকি আদৌ উদ্ধার করা হবে না -তা এখনও নিশ্চিত করে বলে যাচ্ছে না।

ঘটনাস্থলে থাকা মংলা থানার জয়মনির ঘোল নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এখন পর্যন্ত ডুবে যাওয়া কর্গোটি উদ্ধারে কোনো প্রকার কার্যক্রম শুরু হয় নি। বর্তমানে এখানে পুলিশ ও বন বিভাগের কয়েকজন কর্মী ছাড়া আর কেউ নেই।

ডুবে যাওয়া কার্গো এমভি জি আর রাজের স্বত্ত্বাধিকারী দিল খান জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে উদ্ধারকারীরা কার্গোটিকে উদ্ধার কাজ শুরু করবে। কিন্তু সকাল থেকে তিনিও আর ফোন রিসিভ করছেন না।

পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনসহ রামপাল তাপবিদ্যৎ স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ব্যক্তি ও সংগঠনের সদস্যরা সুন্দরবনে জাহাজ ও কার্গোডুবির ঘটনাকে বনের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতেও এ নিয়ে শুরু হয়েছে নিন্দার ঝড়।

ঘটনার পর আগের ধারাবাহিকতায় বন বিভাগের মামলা দায়ের ও তদন্ত শুরুর বিষয়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত সংবাদ ফেসবুকে শেয়ার কারে তানিম আশরাফ নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘ইনডেমনিটি আইন করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী মালবাহী জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া হোক, যেন বন বিভাগ মামলা করতে না পারে। ’ বিদ্রুপের স্বর ফুটে ওঠা ওই স্ট্যাটাসে তিনি প্রশ্ন করে আরো লিখেছেন, জাহাজ চলাচল করলে জাহাজডুবি হবে না তো কি বাসডুবি হবে?

গত ডিসেম্বরে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর সরেজমিনে সুন্দরবনে আসা গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দীন খান তার ফেসবুকে লিখেছেন, আসুন সুন্দরবনের জানাজার প্রস্তুতি নেই! এই প্রাকৃতিক বর্মকে ধীরে ধীরে হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের নামে দাতাগোষ্ঠীর দুয়ারে দুয়ারে অর্থের জন্য ধর্না দেওয়া, আরেক দিকে জলাবনটি ধ্বংস করা! অথচ এই জলাবনের কার্বন নিঃসরণ ঠেকানোর ক্ষমতা অন্য ভূমিভিত্তিক বনের চাইতে ৪/১৮ গুণ বেশি। দ্বৈততা আর কাহাকে বলে! তবে একটা বিষয়ে তাদের দ্বৈততা নেই আর তা হলো টাকা! সুন্দরবনের ধ্বংসেও দখল করা জমির সাথে টাকা আর জলবায়ু সঙ্কটের দোহাই দিয়েও নিজের পকেটে টাকা!
 
কয়লার ক্ষতিকর দিক বিষয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সত্তার বলেন, কয়লায় সালফারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর উপদান থাকে। এগুলো বনের জন্য ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের নদীতে তেল, সার, কয়লাসহ যেকোন ধরনের পণ্যবাহী নৌযান চলাচলই ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়।
 
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বংলানিউজকে বলেন, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে পশুর নদীর এই নৌপথ দিয়ে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে কয়লা পরিবহন হবে। তখন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও বাড়বে।

তিনি আরো বলেন, এই ঘটনাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সুন্দরবনের প্রাণিবৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব পড়বেই। আমরা পুরো বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।

সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কয়লাবাহী জাহাজডুবির এ ঘটনা আমাদের জন্য একটা সতর্ক বার্তা। রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক জাহাজ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে চলাচল করবে।

দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বনের ভেতর দিয়ে এভাবে জাহাজ চলাচলে নদীতে কয়লা, তেল-মবিল ও বর্জ্য পড়বে, নৌযানের হর্নের শব্দ, রাতে সার্চ লাইটের আলো প্রাণিকূলের অভয়ারণ্য নষ্ট করবে।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন সরকারের কাছে যে কতটা গুরুত্বহীন বারবার এসব ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে। এগুলো তো অনেক ছোট জাহাজ, সরকার যেভাবে বিষয়টি দেখছে, তাতেই বোঝা যায় যখন পাওয়ার প্লান্ট হবে তখন কি হবে।

তিনি আরো বলেন, সরকার সুন্দরবন রক্ষা করবে বলে যে সারাক্ষণ মিথ্যাচার করছে তা বোঝা যায় যখন একের পর এক জাহাজ ডুবি হচ্ছে কিন্তু সরকার কিছুই করতে পারে না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং অন্যদের যদি এ বিষয় নিয়ে ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থাকত তবে এসব বিষয়ে তারা উদ্যোগ গ্রহণ করতো।

এর সব কিছু থেকে বোঝা যায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সেগুলো খুবই ফাঁপা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
 
এদিকে, ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ফেসবুকে ঘুরপাক খাচ্ছে ‘তেল কয়লায় একাকার, সুন্দরবন চমৎকার। ভিজিট সুন্দরবন বিফোর দ্য বুলডোজার কাম’ নামে একটি স্লোগান।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।