ঢাকা: অফিস শেষ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জুবায়ের হাসান মতিঝিল থেকে যাবেন ধানমন্ডি।
জুবায়ের হাসান নতুন ভাড়া নির্ধারণের বয়ান দিতেই চালক- ‘কাজীর গরু কেতাবে’ বলেই গাড়ি সামনে টান দিলেন। এরপর আরেকটি অটোরিকশাকে দাঁড় করালেন জুবায়ের হাসান। ধানমন্ডি ২৭ যাবো বলতেই অটোরিকশা চালক ভেতর থেকে দরজা খুলে বললেন-‘মিটারে যা উঠবে তার চেয়ে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিবেন। ’ কথা না বাড়িয়ে জুবায়ের হাসান অটোরিকশায় চড়লেন।
জুবায়ের হাসানের মতো এমন অধিকাংশ যাত্রীকেই দেখা গেছে অটোরিকশা চালকদের শর্ত মেনে নিতে।
মতিঝিল, তোপখানা রোড, বিজয় নগর, সেগুনবাগিচা, কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অটোরিকশার নতুন ভাড়া কার্যকর হয়েছে কি-না তা যাচাই করতেই মঙ্গলবার (০৩ নভেম্বর) এমন চিত্র দেখা গেছে। এ প্রতিবেদকও ১০টি অটোরিকশা চালককে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার কথা বললে তারা মিটারের ভাড়ার সঙ্গে বাড়তি অর্থ দিতে বলেছেন।
এরপর অটোরিকশা চালকরা বলছেন- ট্রাফিক বা ভ্রাম্যমাণ আদালত বসলে বলতে, গাড়ি মিটার অনুযায়ী চলছে। এসব শর্ত মেনেই যাত্রীরা অটোরিকশায় ভ্রমণ করছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মালিক-চালকদের চাহিদা অনুযায়ী সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণ হলেও সে নিয়মের ব্যত্যয় দেখা গেছে দু’দিন না যেতেই। মিটারে যাত্রীদের পছন্দের জায়গায় যেতে রাজি হচ্ছেন না চালকরা।
নিজেরা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসে পরিচালিত নামমাত্র খরচে অপারেশন সুবিধার এই বাহনটির মালিক ছাড়া চালক-যাত্রী কেউ লাভবান হচ্ছেন না।
কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালিকরা নতুন করে দৈনিক জমার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। সে অনুযায়ী মিটারে চললে তাদের পারিশ্রমিক উঠবে না।
ঢাকা জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বলেন, অনেক মালিক এখন প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে ১২শ’ টাকা জমা নেন। যদি তারা ৯০০ টাকা করে নেন তাহলে মিটারে চালাতে চালকরা আপত্তি করবে না।
কয়েকজন চালক জানান, মালিকদের দৈনিক মজুরি ওঠাতে তাদের মিটারের বাড়তি ভাড়া নিতে হচ্ছে।
চলতি মাসের ১ নভেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নতুন ভাড়া নির্ধারণ হয়েছে। এতে প্রথম দুই কিলোমিটার ২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং বিরতিকালীন প্রতি মিনিট দুই টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অটোরিকশায় নিয়ম মেনে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে কি-না, তা তদারকিতে মানিক মিয়া এভিনিউতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসায় বিআরটিএ।
এদিকে, নতুন ভাড়া কার্যকর নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা মহানগরীতে ১ ও ২ নভেম্বর পল্টন, প্রেসক্লাব, শাহবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিল, ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুর, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এলাকা পর্যবেক্ষণ করে।
এসব এলাকায় প্রায় ২২৫টি অটোরিকশা চালক ও ২৪৭ জন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এক জরিপ চালায় যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এতে ১৯৮টি অটোরিকশা মিটারে চলাচল করছে বলে চালক-যাত্রী প্রতিনিধিদল জানিয়েছে। বাকি ২৭টি অটোরিকশার ১০টিতে কোনো মিটার পাওয়া যায়নি। ১৭টি অটোরিকশা চালক বা যাত্রীর ইচ্ছায় চুক্তিতে চলাচল করতে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য যে, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার দিন নতুন বর্ধিত ভাড়া কার্যকর করায় ঐদিন (১ নভেম্বর) মিটার জটিলতাসহ নানা কারণে অর্ধেকেরও বেশি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ থাকায় পরীক্ষার্থীসহ নগরীর সাধারণ যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। যা যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
এছাড়াও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মিটার চালু করে চলাচল করলেও অধিকাংশ অটোরিকশা গোপনে চুক্তিতে চলাচল করছে। সরকার নির্ধারিত বর্ধিত দৈনিক জমা ৯০০ টাকা হলেও সিংহভাগ অটোরিকশা মালিক ইচ্ছে মতো জমা আদায় করছে বলে চালকরা অভিযোগ করেছেন। ৯২ শতাংশ যাত্রীর অভিযোগ, অটোরিকশা চালকরা এখনো যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যাত্রীদের চাহিদার তুলনায় এ বাহনের সংখ্যা কম। ফলে চালকদের ইচ্ছার কাছে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া দিয়েও গোপন চুক্তিতে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা। অতিরিক্ত দৈনিক জমা ও আনুষঙ্গিক খরচের পুরোটাই যাত্রীদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
এডিএ/জেডএস/পিসি