চট্টগ্রাম (রাউজান, কোয়েপাড়া): কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কেউ চাকুরিজীবী।
এই কোর গ্রুপের নিউক্লিয়াস হয়েও আছেন একজন তিনি অম্লান কুসুম দেওয়ানজী। সবাই চেনেন অম্লান দেওয়ান নামে। অম্লান একসময় জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে সাংবাদিকতা করেছেন, পরে ঢাকাস্থ ফরাসি দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন কিছুকাল, বিদেশি সংস্থার উচ্চপদে কাজ করেছেন, এখন ফ্রিল্যান্স কনসালট্যান্সি করছেন। কিন্তু তার ধ্যান মান ও জ্ঞান এখন যেনো কোয়েপাড়া। গ্রামে ফিরেছেন অম্লান আর সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন বন্ধুদের নিয়ে এই নতুন উদ্যোগ। গ্রামকে তারা আদর্শ গ্রাম করে গড়ে তুলতে চান। আর সে কারণেই উদ্যোগটির নাম কোয়েপাড়া মডেল ভিলেজ- কেএমভি।
কি করবে কেএমভি? কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে অতীতের ঐতিহ্যমণ্ডিত কোয়েপাড়ায় এই উদ্যোগ সব ওই কৃষি আর শিল্পকে ঘিরে।
এখানে একটি স্কুলও রয়েছে যার নাম কোয়েপাড়া জগৎচন্দ্র সেন কৃষি ও শিল্প উচ্চবিদ্যালয়। যে বন্ধুদের কথা হচ্ছিলো তারাও এই স্কুলেরই এক সময়ের ছাত্র।
স্কুলের নামের সঙ্গে কৃষি ও শিল্প জড়িত হওয়ার ইতিহাস শত বছরেরও বেশি পুরোনো। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে এই স্কুল যে স্থানটিতে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সেখানেই সংগঠিত হয়েছিলো উপমহাদেশের প্রথম কৃষি ও শিল্প মেলা। সে ইতিহাস স্কুল শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে। এখনকার শিক্ষার্থীরা যেমন জানে, প্রাক্তনরাও জানেন। সেবারের সেই মেলায় কবিগুরু রবি ঠাকুরেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু বৃটিশ সরকার সেখানে জারি করে ১৪৪ ধারা। সে সময় রবি ঠাকুর যোগ দিতে না পারলেও সেই ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। আর পরে যখন দানবীর জগৎচন্দ্র সেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, এর নামের সঙ্গেই তিনি জুড়ে দিলেন কৃষি ও শিল্প শব্দ দুটি।
গ্রামের বন্ধুরা ওই কৃষি আর শিল্পকেই বেছে নিয়েছেন তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথা হিসেবে। তবে কৃষিতে এক নতুনত্ব তারা নিয়ে এসেছেন স্ট্রবেরি চাষের মধ্য দিয়ে। কোয়েপাড়ার স্ট্রবেরি নাম করেছে গেলো বছরই। এ নিয়ে বাংলানিউজে সম্প্রতি প্রকাশিত হয় ‘কোয়েপাড়ায় স্ট্রবেরির স্বপ্ন, এবার চাষ গরুর হালে’ শিরোনামের খবর। তাতে স্ট্রবেরির যে চমৎকারিত্ব বন্ধুরা দেখিয়েছেন তাতে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে তারা পারেন। আর বন্ধুদের যুথবদ্ধ হয়ে থাকার যে প্রত্যয় আর আরও যে কাজগুলো দেখা যায় কোয়েপাড়া গ্রাম ঘুরে তাতে মনে হলো- তারা পারবেন। তারা আরও কিছু করতে পারবেন।
মূলমন্ত্র একটা- আমাদের গ্রাম, আমরাই গড়বো।
কীভাবে? কোন পথে? সে প্রশ্নে স্ট্রবেরি চাষে সাফল্যের কথা জানিয়ে অম্লান দেওয়ান বললেন, আমরা নতুনত্বে বিশ্বাসী, কৃষিতে স্ট্রবেরি চাষ নতুন কিছু। চাষে সাফল্য এসেছে। গেলো বছর দেড় হাজার স্ট্রবেরি চারা রোপন করি, এবর বিশ হাজার চারা রোপনের জন্য জমি প্রস্তুত হচ্ছে। আগামি বছরগুলোতে আরও আরও বাড়বে।
গ্রামের চাষিরাও একসময় নিজেদের জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করবেন। তা থেকেই কোয়েপাড়ায় ঘটে যাবে স্ট্রবেরি বিপ্লব।
কর্ণফুলীর তীরে উর্বরা জমি হলেও কোয়েপাড়ার চাষিদের মাঝে ধান চাষের বাইরে রবিশস্য ফলানোয় আগ্রহ খুব কম। তবে স্ট্রবেরি তাদের মনে জাগিয়েছে নতুন আশা। এর প্রতি এরই মধ্যে চাষিরা আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছেন। কেভিএম’র অন্যতম সংগঠকদের একজন মনজুর মিয়া বলেন, লাভ হবেই। তাই কৃষকরাও ঝুঁকছেন এই চাষে। একই প্রত্যয় অপর বন্ধু এখলাস হোসেনের কণ্ঠে।
অম্লান জানান, স্ট্রবেরি বেশি বেশি উৎপাদন হলেও ক্ষতি নেই বাজারজাত করার দায়িত্ব নেওয়া হবে কেএমভি থেকেই। এ জন্য কোল্ড স্টোরেজ প্রকল্প হাতে নেওয়ার ভাবনা রয়েছে তাদের।
গ্রামকে নিয়ে আরও উদ্যোগ রয়েছে কেএমভি’র। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বোট প্রকল্প। আধুনিক মানের ইঞ্জিন চালিত নৌকা তৈরি করার জন্য কাজ চলছে। গ্রামের মানুষকে আঁকা-বাঁকা ভাঙাচোরা ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় চট্টগ্রাম শহরে। এতে সময় ও অর্থ দুইই বেশি খরচ হয়। কর্ণফুলী নদী ধরে একটি রোট রুট চালু করতে পারলে কোয়েপাড়ার শত শত মানুষের দুর্ভোগ কমবে। এতে ব্যবসা যেমন হবে, তেমনি গ্রামবাসীর জন্য নিশ্চিত হবে ঝামেলামুক্ত পথ চলা।
অম্লান বলেন, আমরা যেখানে সমস্যা সেখানেই ব্যবসার সুযোগ এই তত্ত্ব মাথায় রেখে কাজ করছি। বোট প্রকল্প তেমনই একটি উদ্যোগ।
কোয়েপাড়াকে এই প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বাংলাদেশে নৌকার প্রেমে পড়া এক ফরাসি। আগে থেকেই পরিচয়। তারই সূত্র ধরে অম্লান দেওয়ান যোগাযোগ করেন ইভস মারে নামে ওই ফরাসি বন্ধুর সঙ্গে। থাকেন চট্টগ্রামে। কোয়েপাড়ার জন্য আধুনিক ও যথাযথ বোট তৈরির কাজ এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছেন তিনি।
তবে কেবলই যে ব্যবসা তাই নয়, এখানে একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, গ্রাম তথ্য কেন্দ্র স্থাপন, সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ারও উদ্যোগ রয়েছে তাদের।
‘আমাদের কোয়েপাড়া’ নামে একটি প্রকাশনা বের করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
কোয়েপাড়ায় এরই মধ্যে রয়েছে শত বছরের পুরোনো সমবায় সমিতি। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সমবায় ব্যাংকেই চলে কেভিএম’র ব্যাংকিং কার্যক্রম। এছাড়াও গ্রামের অনেক কাজেরই ব্যাংকিং চলে এখানে। একটি হাসপাতাল ও কলেজ রয়েছে এই গ্রামে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে, মাস্টার দা সূর্যসেনের সাহসী সব অভিযান পরিচালিত হয় এই কোয়েপাড়া গ্রাম থেকে, মহান মুক্তিযুদ্ধেও রাউজানের এই গ্রাম ছিলো কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শহীদ হয়েছেন নির্মল সেন, রজত সেন, শৈলেশ্বর, রোহিনী, আবদুস সাত্তার, মীর আহমদরা। শহীদদের স্মৃতি ধরে রেখে তৈরি হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ। তবে এইসব শহীদদের আত্মত্যাগের চেতনা গ্রামবাসীর মাঝে আজও বিরাজমান। তারুণ্যের মাঝে রয়েছে অদ্যম উদ্যম। তারই এক জলন্ত প্রকাশ এই কোয়েপাড়া মডেল ভিলেজ প্রকল্প। কোয়েপাড়া হয়ে উঠুক দেশের হাজারো গ্রামের কাছে আদর্শের সেটাই প্রত্যাশা।
কোয়েপাড়ায় সেরা স্ট্রবেরির স্বপ্ন, এবার চাষ গরুর হালে (ভিডিওসহ)
বাংলাদেশ সময় ১৩৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
এমএমকে