খাগড়াছড়ি: পর্যটন জেলা খাগড়াছড়ির বিশাল চাষযোগ্য জমি এখন তামাকের দখলে। এর ফলে একদিকে যেমন কমছে জমির উর্বরতা, অন্যদিকে চাষ-প্রক্রিয়াজাতকরণে পরিবেশের ওপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব।
এছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে কয়েকশ’ চুল্লি। প্রতিবছর এসব চুল্লিতে পোড়ানো হয় হাজার-হাজার টন গাছ-কাঠ। এর প্রভাব পড়ছে পাহাড়ের জীব-বৈচিত্র্যে।
পার্বত্য এ জেলার মাইনী, চেঙ্গী ও ফেনী নদীর অববাহিকার অধিকাংশ উর্বর জমিতে প্রধানত এই তামাকের চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যার পরিমাণ ৬৩২ হেক্টর।
পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে তামাক চাষ বন্ধে বিভিন্ন সময় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের যেন কিছুই করার নেই। তাই চরমভাবে ক্ষুব্ধ এ জেলার সচেতন কৃষক ও পরিবেশ সচেতন মানুষ।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, এ বছর খাগড়াছড়ির ছয় উপজেলার ৬৩২ হেক্টর আবাদী জমিতে চাষ হচ্ছে তামাক। তবে এই তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর পার্থক্য আছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তামাক কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, দু’টি তামাক কোম্পানি খাগড়াছড়ির চার উপজেলায় ৭৯০ হেক্টরেরও বেশি জমিতে তামাক চাষ করছে। এর মধ্যে দীঘিনালায় ৬৫০ হেক্টর, মাটিরাঙ্গায় ৭০ হেক্টর, মহালছড়িতে ৫০ হেক্টর এবং মানিকছড়িতে ২০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।
আর দীঘিনালায় তামাক ধূমায়িত করার জন্য ৬ শতাধিক চুল্লি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টন গাছ ও কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এতে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। পরিবেশ ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে।
সরেজমিনে দীঘিনালা ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড় থেকে শুরু করে ঘরের আঙ্গিনা সবখানে চাষ হচ্ছে তামাক। যে দীঘিনালা উপজেলা থেকে জেলার সব থেকে বেশি কৃষিপণ্য উৎপাদিত হতো, সেই দীঘিনালায় এখন জেলার সব থেকে বেশি তামাক চাষ হচ্ছে।
কথা হয় মাইনী ব্রিজ এলাকার তামাক শ্রমিক নূর জাহান ও নাসিমা বেগমের সঙ্গে। তারা বলেন, আগে শাক সবজির ক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করতাম। কিন্তু তামাক চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে তামাক ক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করছি। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করলে ১৫০ টাকা করে মজুরি পাই।
তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে বিশেষত নারী ও শিশুরাই বেশি জড়িত। এ কারণে তারা যক্ষ্মা, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ ও নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক কৃষক জানান, তারা নিয়মিতভাবেই ভেনটোলিন ট্যাবলেট ব্যবহার করছেন।
লাল বানু ও মল্লিকা আক্তার বলেন, তামাক ক্ষেতে কাজ করা ক্ষতিকর। তারপরও জীবিকার তাগিদে করতে হয়। তার অভিযোগ, তামাক চাষ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হলেও আমাদের চিকিৎসার কোনো খরচ দেওয়া হয়না।
তামাকচাষি ফজর মিয়া বলেন, তামাক কোম্পানি থেকে ৫০ হাজার টাকা বিনা সুদে লোন পেয়েছি, তামাকের বীজ দেওয়া হয়েছে। আর তামাক চাষে লাভও বেশি, তাই ক্ষতির কথা জেনেও এই চাষে এখনো আছি। তবে তিনি এই চাষ থেকে সরে আসতে চান বলে জানান।
এদিকে শাকসবজি চাষী ঝন্টু কামার দাশ ও রঞ্জন চাকমা বলেন, আগে খেতে ভালো ফলন হতো। কিন্তু দিনে দিনে এই ফলন কমে আসছে। তাদের মতে, ক্ষতিকারক তামাকে অতিরিক্ত সার-কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পাশের সবজি বা অন্য ফসলে পোকার আক্রমণ বাড়ছে, মাটির উর্বরতা কমছে। আর এ কারণে শাক সবজির চাষ কমছে।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ড. শহীদ হোসেন চৌধুরী বলেন, তামাক চাষ বন্ধে কোনো আইন নেই। তাই সরাসরি তামাক চাষ বন্ধে আমরা কিছু করতে পারিনা। তবে তামাক পোড়ানোর জন্য চুল্লিতে যে অবৈধভাবে কাঠ পোড়ানো হয় সেখানে আইনের প্রয়োগ করা হবে।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ির ছয় উপজেলায় বিষাক্ত তামাক চাষ হয়। সব মিলে এবার খাগড়াছড়িতে ৬৩২ হেক্টর আবাদী জমিতে চাষ করা হচ্ছে তামাক। তবে গত বছরের তুলনায় এবার তামাক চাষ কিছুটা কমেছে। ২০১৫ সালে ৮০৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়।
এ বছর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় ৪৯৬ হেক্টর, মাটিরাঙ্গায় ৭০ হেক্টর, মহালছড়িতে ৫০ হেক্টর, মানিকছড়িতে ৮ হেক্টর, রামগড়ে ৩ হেক্টর এবং খাগড়াছড়ি সদরের ৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবুল কাশেম বলেন, অতি মুনাফার লোভে ক্ষতিকর জেনেও কৃষকরা তামাক চাষে জড়িয়ে পড়ছেন। আর তামাক চাষের কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদন কমছে। তামাক খেতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে আশপাশের কৃষিক্ষেত্রে ফলন ভালো হচ্ছে না। আমরা কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করছি।
পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের দীঘিনালা উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো প্রতারণা আর প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। এ কারণে দীঘিনালায় খাদ্য শস্য উৎপাদন কমে গেছে। বিঘ্নিত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। আর এই তামাক চাষে পরিবেশের ক্ষতিই কেবল হচ্ছে না, দীর্ঘ মেয়াদে ভূমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে হচ্ছে।
তিনি এ ব্যাপারে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
জেলার সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, তামাক চাষে পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াও খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তারা কৃষকদের খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় ধান, শাকসবজি উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে আইন করে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
এমজেড/জেডএম