ঢাকা, সোমবার, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

থানার সামনেই ‘পকেট কাটার হাট’!

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
থানার সামনেই ‘পকেট কাটার হাট’! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানা থেকে মাত্র ৫ গজ দূরত্ব। থানাঘাটের এ সড়কটির দু’পাশে ছোট ছোট ড্রাম নিয়ে বসে আছেন টিকিট বিক্রেতারা।

নানা হাঁকডাকে বিক্রি হচ্ছে অবৈধ ‘দৈনিক পদ্মা র‌্যাফেল ড্র’র টিকিট। প্রতি টিকিটের দাম ২০ টাকা। প্রথম পুরস্কার ১০০ সিসি মোটরসাইকেল। মোট পুরস্কার ৭১টি।

ওই এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদে জেগে উঠা বালুচরে ‘মুক্তিযোদ্ধা বিজয় মেলা’র নাম করে রীতিমতো অভিনব কায়দায় লোভনীয় পুরস্কার দেয়ার নামে চলছে এমন নজিরবিহীন প্রতারণা। নিয়ম করে প্রতি রাতে থানার সামনে ‘পকেট কাটার হাট’ বসলেও দিনমান তারা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা নগরজুড়ে।

নিত্যদিন সকাল থেকে রাত অবধি নগরীর বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করে বিক্রি হচ্ছে লটারির টিকিট। তাদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে পুরস্কারের আশায় এক বা একাধিক টিকিট কিনছেন হাজার হাজার মানুষ।

বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) ও শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) রাত ৯ টা থেকে ১১টা পর্যন্ত থানাঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেলো এমন চিত্র। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর শেষ হলেও নতুন বছরের ১৭ জানুয়ারি শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা বিজয় মেলা! অপরাধ প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত থানাঘাটের খাস জমিতে চলা এ মেলা নিয়ে নগরবাসী হয়ে উঠেছেন আতঙ্কিত।

নগরীর থানাঘাট এলাকায় ছোট ড্রামের উপর রেখে টিকিট বিক্রির সময়েই আলাপ হলো সুকুমার নামে একজনের সঙ্গে। বয়স পঞ্চাশের কোটায়। সকাল থেকে একটি রিকশায় মাইকিং করে টিকিট বিক্রি করেছেন। ঘড়ির কাঁটায় রাত ৮টা বাজতেই এসেছেন এখানে।

তার সঙ্গে আলাপ শুরু হতেই পড়িমরি খেয়ে এগিয়ে এলেন মানিক। তিনি সুকুমারদের মতো টিকিট বিক্রেতাদের বস। তার অধীনে প্রতিদিন নগরীতে চলছে অবৈধ র‌্যাফেল ড্র’র টিকিট বিক্রি করা ৩৩টি রিকশা। থানার সামনে কীভাবে লটারির টিকিট বিক্রি করছেন, সমস্যা হয় না, প্রশ্ন করতেই স্মীত হেসে মানিক বলেন, ‘সব ম্যানেজ কইরাই তো হচ্ছে। ’

সূত্র জানায়, ১৫টি শর্ত বেঁধে দিয়ে গত ১৩ জানুয়ারি ১৫ দিনের জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে মেলার অনুমতি দেন সহকারী কমিশনার রাশেদা আক্তার। শর্তের কোথাও র‌্যাফেল ড্র চলবে, এমন কথা উল্লেখ নেই। এসবের পাশাপাশি নগরজুড়ে শতাধিক মাইকে প্রচার করা হচ্ছে এক মাসব্যাপী মেলার কথা।

সূত্র মতে, অবৈধ ‘দৈনিক পদ্মা র‌্যাফেল ড্র’ লিজ নিয়েছেন রেজাউল করিম নামে একজন।

লটারির টিকিট বিক্রিতে নিয়োজিত দু’শতাধিক ব্যক্তি বহিরাগত। তাদের কারো বাড়ি হয় মাগুরা, নয়তো নেত্রকোণায়। কেউ কেউ আবার বরিশাল ও জয়পুরহাটের বাসিন্দা। তাদের দৈনিক বেতন ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা, দাবি আয়োজকদের।

থানাঘাটের সড়ক পেরিয়ে ওই মেলার ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, মেলায় নামকাওয়াস্তে কয়েকটি স্টল বসানো হয়েছে। বেশিরভাগ স্টল এখনো বসানো হয়নি। ৫৫টি স্টল তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত ফাঁকাই রয়েছে ৩৫টি।

নগরীর প্রভাবশালী নেতাদের আস্থাভাজন আলোচিত-সমালোচিত আক্তার হোসেন এ মেলা’র প্রধান সমন্বয়ক। ইতোপূর্বেও তার বিরুদ্ধে র‌্যাফেল ড্র ও লটারির আয়োজন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, আয়োজকরা মেলার জন্য কোন প্রচারণা না করে শুধু র‌্যাফেল ড্রর প্রচারণা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এ কারণে মেলায় দর্শনার্থী না আসায় উল্টো তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

মেলার একটু অদূরেই বিশাল মঞ্চে ঠাসা মোটরসাইকেলসহ নানা পুরস্কার। ঘড়ির কাঁটা রাত ৯টার ঘরে পৌঁছুতেই সেখান থেকেই ‘মাথাই নষ্ট’ কিংবা ‘উঠাও বাচ্চা, ২০ টাকায় ১শ’ সিসি মোটরসাইকেলসহ নানা প্রলোভনের কথা প্রচার করা হচ্ছে মাইকে।

মঞ্চেই প্রতিদিন রাত ১০টার পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে র‌্যাফেল ড্র। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রতিদিন প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হলেও পুরস্কার দেয়া হচ্ছে গড়ে মাত্র দেড় থেকে দু’লাখ টাকার। এভাবেই স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রতিদিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আখতার-রেজাউল সিন্ডিকেট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোতোয়ালী মডেল থানার এক উপ-পরিদর্শক বাংলানিউজকে জানান, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গত ২১ জানুয়ারি অবৈধ র‌্যাফেল ড্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

থানার সামনেই অবৈধ র‌্যাফেল ড্র ও লটারির বিষয়ে জানতে চাইলে কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘র‌্যাফেল ড্র’র বিষয়টি আমার জানা নেই। এরপরেও কেউ যদি কোন অভিযোগ করে তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। ’

একই বিষয়ে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনুমতিবিহীন র‌্যাফেল ড্র অবৈধ। ক’দিন আগে একবার এটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আবার যদি চালু হয়ে থাকে তবে অবশ্যই বন্ধে ব্যবস্থা নেবো। ’

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।