ঢাকা, বুধবার, ১ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

গোলাম আযমের দেশ প্রেম

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬
গোলাম আযমের দেশ প্রেম ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ভেলোর (তামিলনাডু) থেকে : আলাপ পরিচয় অনেক আগেই হয়েছিলো। দাদা বাংলাদেশতো মনে হয় এখন অনেক স্টাবল (স্থিতিশীল)।

ছোট্ট করে জবাব দিলাম হ্যা।

এক কথা শুনেই পাশের সিটে বসা গোলাম আযম সাহেব যেনো উত্তেজিত হয়ে গেলেন। কি বলেন, দেশটা শেষ হয়ে গেছে। লোকজনের কোন নিরাপত্তা নেই।

পুলিশ, তল্লাসির নামে লোকজনের ব্যাগে থাকা টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। আপনি গেলে আপনার ব্যাগে গাজা-ইয়াবা ভরে মামলার হুমকি দিয়ে দুই লাখ টাকা আদায় করবে। এমন অবস্থা।

এইতো কয়েকদিন আগে পুলিশ একজনকে ধরে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করে। পরে মিডিয়া যখন ফলাও করে প্রচার করেছে সরকার বাধ্য হয়ে ওই পুলিশকে বরখাস্ত করেছে।

বাংলাদেশ এখন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সাধারণ নাগরিকের কোন নিরাপত্তা নেই। কোন কথা বলা যায় না। বললেই গুম। না হলে ক্রসফায়ার করে মেরে দিবে। যাকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে ক্রসফায়ার দিচ্ছে।

ভেলোর (তামিলনাডু) থেকে হাওড়াগামী পুদুচেরী এক্সপ্রেসে ভারতীয় এই বাঙালীর কাছে এভাবেই বাংলাদেশকে তুলে ধরলেন রাজশাহীর লক্ষীপুরের বাসিন্দা গোলাম আযম। পরে জানাগেলো তার আদি নিবাস নাটোরের লালপুরে। ব্যবসা করেন চিনিকলের সঙ্গে।

গোলাম সাহেব ভেলোরে সিএমসিতে (ক্রিচিয়ান মেডিকেল কলেজ) চিকিৎসা শেষে সস্ত্রীক দেশে ফিরছিলেন। আর ভারতীয় বাঙালী ভদ্রলোকও চিকিৎসা শেষে কলকাতা ফিরছিলেন একই ট্রেনে।

গোলাম আযম সাহেব যেনো থামতেই চাচ্ছিলেন না। বলেই যাচ্ছিলেন। এবার বললেন, দেখেন আপনার দেশে (ভারতে) নেতাদের মধ্যে দেশপ্রেম রয়েছে। আমাদের দেশে নেতাদের কোন দেশপ্রেম নেই। টাকা হলে ওরা আপনার কাছে দেশটাকে বিক্রি করে দিতে পারবে। দেশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এই যে দেখেন পচা গম কারনে ভারত বলেছে এই গম তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। সেই ১২’শ কোটি টাকার পচা গম নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাদের দেশে। মন্ত্রী ফোন দিয়েছে নিয়ে নাও। নিয়ে নিয়েছে।

ভারতীয় ভদ্রলোক কথার মধ্যেই বললেন, আপনাদের তৈরি পোষাকের খ্যাতিতো এখন সারা বিশ্বে। গোলাম আজম সাহেব এবারও বলে উঠলেন, গার্মেন্ট শেষ করে দিচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা আর আসছে না।

আসবে কেনো। দেশে কোন গণতন্ত্র নেই। একদলের শাসন চলছে। কোন বিরোধীদল নেই। বিরোধীদল কথা বলতে গেলে তাদেরকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশে বলতে গেলে কোন নির্বাচন হচ্ছে না। ভোটে দিন আপনাকে ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে না। আপনি ভোট দিতে গেলে বলবে, আপনার ভোট দেওয়া হয়েছে।
আপনার দেশে সিটি করপোরেশন আছে? ভদ্রলোক জবাব দিলেন হ্যা কলকাতা মিউনিসিপ্যাল রয়েছে। এগুলো কি জনপ্রতিনিধি চালায় না-কি মনোনিত লোক? ভদ্রলোক জবাব দিলেন নির্বাচিত লোক!

গোলাম আযম সাহেব বললেন, আমাদের দেশে জোর করে নির্বাচিত মেয়রদের জেলে দিচ্ছে সরকার। সেই জায়গায় তাদের নিজেদের দলের লোককে বসাচ্ছে।
এইতো সেদিন পৌরসভা নির্বাচন হলো। প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছে কাকে কাকে নির্বাচিত করতে হবে। জোর করে তাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ভোট কম পেয়েছে তাদের নাম ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এই যে দেখেন আপনাদের দেশে ট্রেন কতো টাইম অনুযায়ী চলে। কিন্তু আমাদের দেশে ৬ ঘণ্টার পথে বারো ঘণ্টা লেট হয়। সেদিন আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী গেলাম ৪’শ কিলোমিটার। চার ঘণ্টা লেট। আপনাদের দেশে ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটলে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করে। কিন্তু আমাদের দেশে যতই মানুষ মরুক কোন মন্ত্রীর পদত্যাগের কথা শুনেছেন?

ভারতীয় ভদ্রলোক কথার ফাকেই ছোট্ট করে বললেন, এইটা কথার কথা। দেখানতো আমাদের দেশেও কয়জনমন্ত্রী পদত্যাগ করেছে। নাম বলতে পারবেন! কিন্তু গোলাম আযম সাহেব সেদিকে গেলেন না।

বললেন, আমাদের সরকার রেলটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। লোকজন রেলে উঠতে চায়। কিন্তু টিকেট পাচ্ছে না। চাহিদা আছে কিন্তু রেল বাড়াচ্ছে না, বাস মালিকদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে। সবগুলো খাত শেষ করে দিচ্ছে।

ভারতীয় ভদ্রলোক এবার প্রসঙ্গ বদলে বললেন, আপনাদেরতো মনে হয় বেশি কয়লা নেই। এবার গোলাম আযম সাহেব ব্যাখ্যা দিলেন, আরে আমাদের মাত্র একটি খনি আছে সেই কয়লার মান ভালো না। শুধু ইট পোড়ানো ছাড়া আর কিছুই হয় না। ভারতের কয়লা দিয়ে দেশ চলছে।

মাঝে মাঝেই মৃদু প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু থামানো যাচ্ছিল না। কিন্তু এবার কিছুটা সুযোগ পেয়ে বললাম, ওনার (গোলাম আযম) তথ্য সঠিক নেই। ওনি হয়তো বিষয়টি ভালো করে জানেন না। বাংলাদেশের কয়লার মান অনেক ভালো। আর খনিতে বিশাল রিজার্ভ রয়েছে। তবে এখন মাত্র একটি খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।

দমবার পাত্র নন গোলাম আযম সাহেব। এবারও পাল্টা কথা ধরলেন। বললেন, ‘আমি বড়পুকুরিয়ায় অনেক গেছি। সেখানে স্টিম কোল নেই, না জেনে বলছিনা। এবার গোলাম আযম সাহেবের স্ত্রী মুখ খোলেন। থাক এভাবে দেশের দুর্নাম করিও না।

কথার মধ্যেই কামরায় হাক পড়ে ফেরিওয়ালার, এই চকলেট, কুড়কুড়ে, চকলেট কুড়কুড়ে। নতুন উৎস খুজে পান স্বদেশী গোলাম আযম সাহেব। বলে ওঠেন দেখেন, আপনাদের বিস্কিটের প্যাকেটে উৎপাদনের তারিখ মেয়াদ লেখা রয়েছে। আর খাবারের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

আর আমাদের দেশে বিএসটিআই রয়েছে দেখার জন্য। তারা টাকা হলেই সব ছাড়পত্র দেয়। সব খাবারে ভেজাল। ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে আছি। দুই ছেলেকে বলেছি। এই দেশেরতো ভবিষ্যত নেই। তোরা বড় হয়ে বিদেশে চলে যাবি। এখানে থাকার কোন দরকার নেই।

একত্রিশ ঘণ্টার যাত্রাপথে তবুও যেন তার খেদ শেষ হচ্ছিল না। এবার বললেন, দেখেন আমাদের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সেখানে ভেতরে বানানো হচ্ছে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেনো এইটাকি অন্য কোথাও করা যেতো না। সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

বনের ভেতরে তেলের ট্যাংকার ফাটিয়ে দেওয়া হলো। মানুষ সেই তেল তুলতে গেলে তুলতে দেওয়া হয় নি। তেল ছড়িয়ে সুন্দরবন বিরান হয়ে যাচ্ছে।

ভারতে সিনিয়র সিটিজেনদের কত সুবিধা। আপনি টিকেট কাটলেন চল্লিশ শতাংশ কম দামে। কিন্তু বাংলাদেশে সিনিয়রদের কোন সম্মান নেই। এবারও প্রতিবাদ করতে হলো। বাংলাদেশেও বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় ভদ্রলোক বললেন তাই না-কি। তখন গোলাম আযম সাহেব বললেন, আরে এক’শ কি দুই’শ টাকা করে। এটা কোন টাকা হলো না-কি।

বাংলাদেশে এখন পাবলিক পরীক্ষার আগের দিনে প্রশ্নপত্র ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাৎস করে দেওয়া হয়েছে। ভালো ছাত্ররা ভর্তি হতে পারেনি। খারাপরা ভর্তি হয়েছে। এরা ডাক্তার হয়ে কি করবে? দেশের মেরুদন্ড শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।

খানিকটা ভাব সর্বজান্তার মতো। তুললেন কৃষি প্রসঙ্গ। দেখেন আপনাদের এখানে কতদূর ক্যানেল করে সেচের জন্য কৃষককে পানি দিচ্ছে সরকার। আর আমাদের দেশে কৃষকের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। কৃষক তার পন্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না।

আবার কথা ধরলাম। আপনার তথ্য সঠিক নয়। বাংলাদেশেও অনেক সেচ প্রকল্প রয়েছে, তিস্তু সেচ প্রকল্প, কুষ্টিয়াতেও এর রকম সেচ প্রকল্প রয়েছে। বরেন্দ্র এলাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে দিয়েছে সরকার। আখ, পাটে প্রনোদনা দিচ্ছে। কৃষকদের বিনামূল্যে সার-বীজ প্রদান করা হয়। এবারও স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন কে পেয়েছে বলতে পারেন? ওই সরকারের চেলা চামুন্ডারা।

ট্রেনটি বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) বিকেলের মধ্যে তামিলনাডু ছাড়িয়ে উড়িষায় প্রবেশ করার কথা। কিন্তু জানা গেলে ২ ঘণ্টা লেটে চলছে। তখন গোলাম আযম সাহেব কিছুটা থমকে গেলেন। হায় হায় ভারতের রেলের এতো সুনাম গাইলাম আর এখন দেরি হচ্ছে। দুই ঘণ্টা লেট মানেতো রাত একটার পর হাওড়া স্টেশনে পৌছাবে। তাহলেতো রাতে বের হতে পারবো। সারারাত স্টেশনেই থাকতে হবে।

গোলাম আজম সাহেবের নামটা অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম। তার নাম বলার ভঙ্গিটাও অনেক চমৎকার। বললেন আমার নামটা মনে রাখা সহজ ঐতিহাসিক নাম, গোলাম আযম। এই নাম নিয়ে আপনার কোন আক্ষেপ হয় না, কেন হবে এটা একটা পবিত্র নাম। আমার বন্ধুরা অনেকে বলে কিন্তু তাদের কথায় পার্তা দেই না।

সাধারণ নতুন কোন যায়গায় গেলে আমার মনের মধ্যে রোমাঞ্চের আবহ তৈরি হয়। মাঠের বুক চড়ে দানবীয় গতিতে চলা ট্রেনের দুপাশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য মনকে ভরিয়ে তোলার কথা। তামিলনাডু মোটর বাইক নিয়ে রান্নার শুকনো খড়ি সংগ্রহ করার দৃশ্য, কখনও মোটরবাইকে পেছনে বস্তা বোঝাই মালামাল, আবার স্কুটিতে ছোট্ট বাচ্চাদের দাড়িয়ে ভ্রমণ (চালকের সামনে ফাকা আসনে ছোট্ট বাচ্চাদের দাৎড় করে রাখা), বিশাল বিশাল পাহাড়, আবার পাহাড়ের চারপাশে বিশাল জলরাশি মনকে রাঙ্গা ব্যর্থ হলো।

পুরো সময় জুড়ে মনটা বিশিয়ে থাকল। বিদেশিদের কাছে দেশের দুর্নাম করে কি লাভ গোলাম আযম সাহেবদের। কেন তারা দেশকে এতো ছোট করেন। আরো ভড়কে গেলাম এরকমতো লাখো গোলাম আযম বাংলাদেশকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। এখানে না হয় আমি কিছুটা বুঝানোর চেষ্টা করলাম। যেখানে কেউ বলার নেই, সেখানে বিদেশিদের কি বার্তা দিচ্ছি আমরা। কথায় কথায় ইউরোপ আমেরিকার উদাহরণ দিই। কিন্তু কখনও ভাবি না, দেশটার সামর্থ সুখ দু:খের কথা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৬
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।