সুন্দরবন থেকে: কোত্থেকে একটা গাংচিল এসে চোখের সামনে ঝুলে রইলো। জাহাজ থেকে বড়জোর পনেরো হাত দূরে।
প্রথমে মনে হলো, খেলছে বুঝি। কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতেই ভুলটা ভাঙ্গলো। চকিতে উত্তাল পানিতে ছোঁ দিতে দেখে বেশ বোঝা গেলো, মোটেও খেলছে না চিলটা। রোটরের ঘূর্ণিতে জাহাজের পেছনে যে উত্তাল তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, তাতেই নজর নিবদ্ধ চিলের।
অলস উড়াটা আসলে শিকারের প্রস্তুতি। পানিতে ছোঁ মারার গতি ক্ষিপ্র হলেও আগ্রাসী নয়। মনে হলো, যেনো আলতো ঠোঁঠে পানিতে চকিত চুমু খেয়ে ফের আগের জায়গায় এসে উড়ছে।
রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাশ তার কবিতায় যে সোনালী ডানার চিলের ছবি এঁকেছেন, এটা সেই চিলই। ডানা দুটো সোনালী। বুকের নিচটা সাদা। বঙ্গোপসাগরের উপকূল জুড়ে এই চিল এখনো দলবেঁধে শিকারে বের হয়। মানুষের সঙ্গেও দারুণ মিতালী তাদের। জাহাজ থেকে পানিতে খাবার ছুঁড়ে দিলে ছোঁ মেরে তুলে নেয়।
অনেক সময় ধরে পেছন পেছন ঝুলে রইলো চিলটা। ছবি তোলার সময়ও দিলো। তারপর ঘুরে উড়ে গেলো স্মরণখোলা খালের উজানে। একটু পর আর একটা ছোটো চিল এলো বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকলো না।
খালের পানি ঘোলা। দু’পাশে গোলপাতার ঝোপের পেছনে সুন্দরী, গরান, গেওয়াসহ নাম না জানা গাছপালার ঘন বন। মাঝেমধ্যে বৃক্ষসারির ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে একটা দুটো তাল গাছকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো।
সরু নালার মতো খাঁড়ি বনের ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। ভাটার টানে পানির স্তর কয়েক ফুট নেমে যাওয়ায় সেই সরু খাড়িগুলো হয়ে এসেছে আরো সরু।
দু’পাড়ে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা পলি তার পেলব রূপ নিয়ে ফুটে উঠলেও মূল খালে এখনো অথৈ পানি। কুয়াশা পুরোপুরি না কাটলেও অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে।
সকালে খালের উপরে বিছিয়ে থাকা কুয়াশা নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেওয়ার পর পাড়ের পলিতে প্রথম দেখা দিয়ে ছিলো একটা সাদা বক। লম্বা ঠ্যাংয়ের মাপা পদক্ষেপে পজিশন পাল্টে শিকার খুঁজছিলো। জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ মোটেও ব্যঘাত ঘটাতে পারেনি তার মনোযোগে।
এরপর দু’টো চিত্রা হরিণ। পানি নেমে গিয়ে বেরিয়ে আসা পলিমাখা পাড়ে কি খাবার খুঁজছে কে জানে। ইঞ্জিনের শব্দে মুখ তুলে জাহাজটাকে দেখলো একনজর। পরক্ষণেই মুখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।
তারপর ফের একঘেয়ে যাত্রা। হঠাৎ একটা কুমিরকে দেখা গেলো পাড়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। নদী থেকে ভারি শরীর টেনে পাড়ে যে উঠেছে নরম পলিতে তার দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। শুয়ে আছে পলিকাদার ভেতরেই।
আকারে বিশাল। শরীর আর মাথার গড়ন বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে, বয়স হয়েছে তার। ভালো করে দেখার জন্য তার কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়া জাহাজটাকে মোটেই পাত্তা দিলো না সুন্দরবনের পানির রাজা। কেবল এক পলকের জন্য একটু চোখ মেললো এই যা। ভারী শরীরের কোথাও আর কোনো নড়াচড়া ধরা পড়লো না বায়নোকুলারের চোখেও। যেনো কিছুতেই আয়েস হারাতে রাজি নন তিনি।
সুন্দরবন এলাকায় ঢোকার পর এরই মধ্যে প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। গত রাতে শরনখোলা চ্যানেলে কিছু দূর এগুনোর পর ইঞ্জিন বন্ধ করে মাঝ নদীতে নোঙর ফেলতে বাধ্য হন মাস্টার জাহিদুল ইসলাম।
সন্ধ্যার দিকে আকাশে জ্বলতে শুরু করা তারাগুলো ঢাকা পড়েছিলো কুয়াশার সাদা চাদরে। সেই কুয়াশা এতো ঘন যে কয়েক হাত দূরেও দৃষ্টি চলে না। অনুমানে চালালে কুয়াশার শাসানি পাত্তা না দিয়ে ভেসে থাকা জেলে নৌকা যেমন গুঁড়িয়ে যেতে পারে, তেমনি জাহাজটিই হয়তো উঠে যেতে পারে কোনো পলিজমা চরায়।
মাস্টার জাহিদুল তাই আর কোনো ঝুঁকি নিলেন না। কিন্তু জানিয়ে রাখলেন, কুয়াশা কমলেই ফের রওয়ানা হবেন তিনি।
রাতে যদিও বড় বিচিত্র আচরণ করলো কুয়াশা। এই নিজেকে গুটিয়ে নেয়, তো পরক্ষণেই ফের জেঁকে বসে জলপথের পুরোটা জুড়ে।
দু’পাড় থেকে ভেসে আসা নাম না জানা সব পাখির কলতান যখন বুঝিয়ে দিলো সকাল হয়েছে, তখন ফের শুরু হলো জল বাওয়া। ঘণ্টা দেড়েক চলার পর পাতলা হতে গিয়ে আরো যেনো ভারী হয়ে উঠলো কুয়াশা।
কিছুক্ষণ বিরতির পর ফের চলা শুরু। সুপতি ফরেস্ট অফিসের কাছে যখন পৌছুলো তখন সকাল পৌনে দশটা বেজে গেছে। কুয়াশার কারণে ৪ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হলো ১৪ ঘণ্টায়।
এখানে দু’টো প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সারা হলো। জাহাজের পেছনে বেঁধে রাখা স্পিডবোট সুপতি ফরেস্ট অফিসে গিয়ে দু’জন উর্দি পরা গার্ড নিয়ে এলো। এখান থেকে সুন্দরবনের আরো গভীরে গেলে গার্ড নিতেই হবে। তার আগে নিতে হবে গভীর বনে ঢোকার অনুমতি।
এদিকে জাহাজের গায়ে এসে ভিঁড়লো মজিবর শিকদারের ট্রলার। খুলনা থেকে একাই বোট চালিয়ে গত সন্ধ্যায়ই সুপতি খালে এসে অবস্থান নেন তিনি। সঙ্গে ডাব, ভেটকি মাছসহ আরো সব প্রয়োজনীয় সাপ্লাই।
টানা ১৫ ঘণ্টা বোট চালিয়ে এসেছেন। তারপর সারারাত নৌকাতেই কেটেছে তার। বড় একটা পলিথিনের নিচে লেপটা এখনো বিছিয়ে রাখা। পলিথিনটা কুয়াশায় ভিজে আছে। একা একা কুয়াশামোড়া এই গহীন অরণ্যে এভাবে রাত কাটানোর সাহস ক’জনেরইবা হয়?
সাপ্লাই তুলে ফের শুরু হলো জল বাওয়া। ঘণ্টা দু’আড়া্ইয়ে নদী থেকে বেরিয়ে সাগরে চলে এলো জাহাজ। কচিখালীতে যখন নামার সময় হলো তখনই নজরে এলো দুটি বন্য শুকর। পলিতে পা ডুবিয়ে খালে মুখ নামিয়ে পানি খাচ্ছে। জাহাজের দিকে মুখ তুলেও চাইলো না তারা।
একটু দূরে কচিখালী জেটি খাঁ খাঁ করছে। জেটিটা পরিত্যক্ত। আশপাশে মানুষজন তো দূরের কথা, কোনো ঘর-বসতিরও চিহ্ন নেই। ওই জেটি পেরিয়ে নোঙর ফেলা হলো। এবার বাঘমামার অভয়ারণ্যে নামার পালা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
জেডএম
** বিষখালীর বাঁকে মরে আছে ধানসিঁড়ি
** বরিশাল ছুঁয়ে সুগন্ধার পথে
** নদীর বুকে আলোর ভেংচি