ঢাকা: ‘সইমু না আর সইমু না অন্য কথা কইমু না/যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান/এই জানের বদলে রাখুম রে/বাপ-দাদার জবানের মান। ’
ঘাতকের ছিল বুলেট।
মায়ের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালে এমন প্রতিজ্ঞা করে হাসিমুখে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। বুকের রক্ত দিয়ে এ দিনে আদায় করেছে মুখের ভাষা। অমর হয়ে গেছে ফেব্রুয়ারির একুশ।
একুশের প্রথম প্রহর থেকে শুরু হয়ে গেছে নানা আনুষ্ঠানিকতা। জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে। সকলের কণ্ঠে এখন একই শোকসঙ্গীত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি....।
মুখের ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ায় হতবাক হয়েছে বিশ্ব; অবশেষে এমন দিনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হয়েছে জাতিসংঘকে। শুধু বাংলাদেশ নয়; একুশে ফেব্রুয়ারিকে এখন জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে।
রোববার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস।
বছর ঘুরে আবারও এসেছে ভাই হারানোর ব্যথা আর মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবে অত্যুজ্জ্বল সেই দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে এসেছিল বাংলা মায়ের বিক্ষুব্ধ সন্তানেরা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মুখর ছাত্রদের রুখে দিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। বরকত সালাম রফিক শফিক জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেক শহীদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা। সেই থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে। মহান শহীদ দিবস।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে বায়ান্নর রক্তঝরা এ দিনটি মূলত বাঙালির স্বাধিকারের চেতনায় জেগে উঠবারও দিন। দেশের মানুষ একটি দণ্ডে একাত্ম হয়েছিল সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক উদ্দিন, শফিউরের রক্তে সিক্ত অনন্য শোক আর গৌরবের এই দিনে। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার প্রথম নজির। একুশের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বীজ বোনা হয়েছিল। একুশের অনন্য সাহসই প্রতিটি আন্দোলনে বাঙালিকে দুর্জয় শক্তি জুগিয়েছিল।
দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ফুল দিয়ে ভাষার প্রতি নিজেদের ভালবাসার কথা জানাবে। নগ্নপায়ে অংশ নেবে প্রভাতফেরিতে। রোববার শহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হবে শোকের কালো পতাকা।
যেভাবে একুশ
ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ বাঙালি। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল।
এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার ওপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলাভাষী মানুষের সকল অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে পড়ে বাংলার মানুষ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানিদের গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই সকালে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে ঘিরে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিয়ে ছাত্ররা সমবেত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটের সামনে ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে। বিকেল সাড়ে ৩টায় প্রাদেশিক পরিষদের এ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগে থেকেই ১৪৪ ধারা জারি করেছিল প্রশাসন।
এদিকে আমতলার সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা আসামাত্র একের পর এক দশজনের মিছিল বের হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে। শুরু হয় ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের রক্তাক্ত সংঘর্ষ। একপর্যায়ে পুলিশ হঠাৎ করেই মেডিকেল হোস্টেল গেটের সামনে ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে জড়ো হওয়া ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ ও আবদুল জব্বার। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত আবদুস সালাম মারা যান ৭ এপ্রিল। সেই থেকে একুশের দিনটি মহান শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। একের পর এক আন্দোলন চলতে থাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে। গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালের শুরুতেই পাকিস্তানি সামরিক শাসক নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে গৃহীত সংবিধানের মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
ভাষার জন্য বাঙালির বিরল এ আত্মত্যাগ আজ কেবল এ ভূখণ্ডের সীমানায়ই আবদ্ধ নয়, কালের পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক মর্যাদায়ও মহীয়ান হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্যসাধারণ অর্জন।
একুশের প্রথম প্রহর থেকে শুরু নানা আনুষ্ঠানিকতা। জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে। সকলের কণ্ঠে এখন একই শোকসঙ্গীত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।
একুশের কর্মসূচি
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০১৬ উপলক্ষে সারাদেশেই থাকবে নানা আনুষ্ঠানিকতা। ভাষা শহীদদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদও ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
বিকেলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হবে। এখানে বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও গ্রহণ করা হয়েছে পৃথক কর্মসূচি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হবে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। কালোব্যাজ ধারণ করবেন নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীরা সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে কর্মসূচি। বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
এডিএ/জেডএম