কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে: মাথা নুয়ে ছেলে হারাবার শোকে কাতর মা, কিন্তু রয়েছে তার আরও চার ছেলে। মায়ের দুই দিকে দু’জন করে বুক টান দাঁড়িয়ে।
অসম সাহসী ছেলেদের ঘোষণায় পেছনে উঠছে লাল সূর্য। সে সূর্য কেবল মায়ের ভাষায় কথা বলার নিশ্চয়তাই দেয় না, জানান দেয়- উঁকি দিয়েছে চেতনার লাল সূর্য, স্বাধীনতার সূর্য। কাতর মায়ের পায়ের কাছে বেদি রক্তে লাল হয়ে আছে সে রক্ত ছড়িয়েছে অনেকটা জুড়ে। সূর্যের রঙ আর সেই লাল মিলেমিশে একাকার।
ওদিকে সামনে জেগে উঠেছে জনতা। তারা ছুটে ছুটে আসছে। হাতে শ্রদ্ধার ফুল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড। তাদের নগ্ন পা। ধুলিমাখা সেই পা ফেলছে রক্তে ঢেকে থাকা বেদিতে। মুখে তাদের ভাষার শহীদদের স্মরণ, তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার উচ্চারণ-
আ..আ..আ.. আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি...
ভাষার মহান আন্দোলন। সেই মহান আত্মত্যাগের স্মরণ করার এই মিছিলে প্রথমেই বেদির দিকে এগিয়ে আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কী ধীর আলতো পায়ে তাদের এগিয়ে চলা। যেনো বেদিতে মিশে আছে আজো শহীদের লাল রক্ত, পিচ্ছিল বেদিতে আলতো পা ফেলা, রক্তের বেদিতে তাদেরও নগ্ন পা, তাদের শ্রদ্ধার প্রকাশ। বেদিতে ফুল দিলেন তারাই প্রথম।
ফুল দিয়ে রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী মুখ তুলে তাকান সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে। ছেলে হারানোর বেদনায় সে মায়ের মুখ তখনও নত। মায়ের মমতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে সন্তানেরা। এদিকে অনবরত বেজে চলে- আ আ আ... আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...ফেব্রুয়ারি।
শিল্পী হামিদুর রহমানের তৈরি এ এক অনন্য স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ মিনারের এই শান্ত সৌম্য ব্যাপ্তি জাতীয় ঐক্যের এক অন্যতম স্মারক। সেই ঐক্যেরই প্রকাশ ঘটতে থাকে শহীদ মিনারেরর বেদিতে। এদিন সবাই শোকগ্রস্ত, সবাই গৌরবান্বিত, সবাই বেরিয়ে পড়েছে ঘর থেকে। সবারই গন্তব্য শহীদ মিনার।
একুশের গান গাইতে গাইতে তারা ফুল দেয় শহীদের বেদিতে। একে একে শ্রদ্ধার ফুলে ভরে ওঠে বেদি। কত রং, কত রকমের সেই ফুল। রক্তে রাঙানো বেদি ঢেকে যায় ফুলে। আর তাতে চারিদিক যেনো ওঠে হেসে! আর বলে-
আমরা কেনো শোকেই হবো মুহ্যমান! ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য, বাংলার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে/ একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য/
আলাওলের ঐতিহ্য/ কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের/ সাহিত্য ও কবিতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে..তাদের জন্য কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।
একুশ তো গৌরবের। আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই অর্জিত এক গৌরবগাঁথা আমাদের এই একুশ। একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া- বছর ধরে এই একই ধারা চলছে। বাঙালি ভোলে না, কখনোই ভোলে তার পূর্বপুরুষের এই রক্তঝরা আত্মত্যাগ।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে। আর প্রতিবছর শহীদ দিবসের এই জাতীয় মহান দায়িত্বটি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই। রাত তখন প্রথমপ্রহর ছুঁই ছুঁই। ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক অপেক্ষা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি শহীদ মিনার চত্বরে পৌঁছান রাত ১১টা ৫৩ মিনিটে। অভ্যর্থনা জানান ঢাবি উপাচার্য, এরপর দু’জন মিলে অপেক্ষা করতে থাকেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের। তিনি শহীদ মিনার চত্বরে পৌঁছান রাত ১১টা ৫৭ মিনিটে। এরপর দু’জন মিলে ধীর পায়ে এগিয়ে যান মূল বেদির দিকে। রাত ১২টায় প্রথম প্রহর শুরু হলেই বেদিতে ফুল দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
এরপর ফুল দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটু পরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুল দেওয়া হয়, তাতেও নেতৃত্ব দেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ফুল দিতে এগিয়ে যান জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া। ফুল দেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা, তিন বাহিনীর প্রধানরা, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ফুল দেন কূটনীতিক কোরের সদস্যরা।
১২টা ১০ এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর ছেড়ে যান তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। একে একে চলে যান অন্য ভিআইপিরাও। আর শহীদ মিনার উন্মুক্ত হয় সাধারণের জন্য। আর নেমে আসে জনতার ঢল। সে ঢলই প্রমাণ করে মহান একুশে ফেব্রয়ারি আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম স্মারক। এখানে সবাই এক কাতারে। সবারই উদ্দেশ্য এক। শহীদের রক্তে রঞ্জিত বেদি ফুলে ফুলে ভরে তোলা।
তবে ফুলের ডালি আগেই সাজিয়ে রেখেছিলো রাঙা পলাশ। শহীদ মিনারের ঠিক পেছনে থোকা থোকা ফুটে থাকা পলাশের ডালগুলোতেও যেনো আগুন লেগেছিলো। ফুলের ভারেই ডালগুলো আরও ঝুঁকে পড়েছিলো নীচে। যেনো ওরাও স্থান নিতে চায় রক্তরাঙা বেদীতে। সেখানে ভাষার শহীদের প্রতি জানাবে পলাশের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বাংলাদেশ সময়: ০২২১ ঘণ্টা, ফেব্রয়ারি ২১, ২০১৬
এমএমকে/এএ
** ভাষাশহীদদের প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা