ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলার আরেক বর্ণমালা নাগরী

সাব্বির আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
বাংলার আরেক বর্ণমালা নাগরী

ঢাকা: বাংলা ভাষার হারিয়ে যাওয়া একটি লিপি ‘নাগরী’। বর্তমানে অপ্রচলিত এ লিপিতে এক সময় সিলেট অঞ্চলে রচিত হয়েছে অনেক মূল্যবান সাহিত্য।

জটিল সংস্কৃত প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে সে সময় নাগরী লিপির উদ্ভব ঘটেছিলো।

লিপিটি এতটাই সহজ জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, মাত্র আড়াই দিনে তা শেখা যেতো বলে বলা হতো ‘আড়াই দিনে হিকা যায়’।
 
এক সময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্রধানত সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো এ লিপির সাহিত্য। তবে সিলেট ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ভৈরব, আসাম, করিমগঞ্জ ও শিলচরে এর ব্যবহার ছিলো।
 
কয়েক বছর ধরে নাগরী লিপি ও তার সাহিত্য পুনরুদ্ধারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকার উৎস প্রকাশনী। নাগরী লিপিতে রচিত অনেক সাহিত্যরত্ন প্রকাশ করেছে তারা।
 
সংস্থাটির কর্ণধার মোস্তফা সেলিম লিপিটি শেখার জন্য রচনা ও সম্পাদনা করেছেন ‘সিলেটি নাগরী লিপি বর্ণ পরিচয়’ বইটি। প্রাথমিকভাবে নাগরীর সঙ্গে পরিচয় হতে এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে কার্যকর বই।
 
বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রচলন হয় নাগরী লিপি। প্রায় ছয়শত বছর বাংলা লিপির পাশাপাশি সিলেটি নাগরী লিপি চালু ছিলো। একই ভাষা ও সাহিত্যের একাধিক লিপি বর্ণমালার অস্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় বিরল উদাহরণ’।
 
তিনি আরও লেখেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় ব্যবহৃত দুটো বর্ণমালা- একটি বাংলা, অপরটি সিলেটি নাগরী’।
 
নাগরী লিপি পুনরুদ্ধার করে এর সাহিত্য প্রকাশে নিবেদিত মোস্তফা সেলিম বাংলানিউজকে জানান, নাগরী লিপিতে রচিত সাহিত্যের পুথি-পুস্তক বিলুপ্তপ্রায় এবং বর্তমানে এর প্রচলন নেই। তবে অল্প পরিসরে পাকিস্তান আমলে এর চর্চা ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে বিধ্বস্ত হয় সিলেটি নাগরী লিপি মুদ্রণের একমাত্র ছাপাখানা বন্দরবাজারের ইসলামিয়া প্রেস। এরপর সম্পূর্ণ বিলুপ্তির কবলে পড়ে এ ঐতিহাসিক সম্পদ।
 
নাগরী ভাষার গবেষক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশ্রাফুল করিম নাগরী লিপিমালাকে বিজ্ঞানসম্মত এবং রীতিমতো বিস্ময়কর বলে জানিয়েছেন।
 
তিনি বলেন, আধুনিককালের ভাষাবিদরা ভাষাকে সহজ করতে যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করছেন, প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ বছর আগে নাগরী লিপিতে তা করা হয়েছিল।   তিনি আরও জানান, এটা এতোটাই সহজ যে, নারীরা মাত্র আড়াই দিনে শিখতে পারতেন। আর পুরুষদের শিখতে লাগতো মাত্র একদিন।
 
‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, নাগরী লিপিতে বর্ণমালায় বর্ণসংখ্যা ৩২টি। বর্ণগুলো হচ্ছে- আ ই উ এ ও ক খ গ ঘ চ ছ জ ঝ ট ঠ ড ঢ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম র ল ড় শ হ।
 
নাগরী ভাষার আরেক গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক তার ‘সিলেটের নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল’ গ্রন্থে ৩৩টি বর্ণের কথা বলেছেন।
 
নাগরী লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, ইসলাম প্রচারের জন্য ৩৬০ জন আউলিয়াকে নিয়ে এখানে হযরত শাহজালাল আসার পর এটি শুরু হয়।
 
তখন হিন্দুরা সংস্কৃত আর মুসলমানরা আরবির প্রতি অনুরক্ত থাকায় তাদের একই লিপিতে নিয়ে আসতে এ ৩৬০ জন আউলিয়ার মধ্য থেকে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তারা হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি লিপি বের করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, সবার মধ্যে ইসলাম প্রচার।  
 
তিনি আরও বলেন, সহজে শেখা যায় বলে এটি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।   এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, নাগরী বর্ণগুলো আমাদের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক গৃহস্থালি দ্রব্যের মতো হওয়ায় এটি শেখা ছিল সহজ। যেমন- লাঙ্গলের অনুরূপ বর্ণ আছে নাগরীতে।
 
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নাগরী লিপি চর্চার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে চালু করা হয়েছে নাগরী লিপির ফন্ট। নাগরীর উৎপত্তিস্থল সিলেটে নাগরী লিপি শেখার জন্য একটি ইনস্টিটিউট ও নাগররী চর্চা কেন্দ্র খোলা হচ্ছে।
 
উৎস প্রকাশনীর মোস্তফা সেলিম সেখানে একটি নাগরী জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে বলেও জানিয়েছেন।
 
গবেষক ড. আশ্রাফুলের মতে, ভাষাটির চর্চা ও গবেষণা হলে অনাবিষ্কৃত অনেক পুঁথি উদ্ধার সম্ভব, যার মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য নতুন করে বিনির্মাণ হবে।
 
বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে জানা গেছে, হালের অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে, যেগুলো নাগরী লিপিতে লেখা হয়েছিল। যেমন- সৈয়দ শাহনূরের (১৭৩০-১৮৫৫) ‘অরিন জংগলার মাঝে বানাইলাম ঘর/ভাই নাই, বান্ধব নাই, কে লইব খবর’ কিংবা শিতালং শাহের (১৮০০-১৮৮৯) ‘অজ্ঞান মন, খুয়াইলায় মহাজনের ধন’ ইত্যাদি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
এসএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।