সুন্দ্রাটিকি (বাহুবল) থেকে: গ্রামের ৪ শিশু হত্যায় ইতিমধ্যেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন হত্যায় অভিযুক্ত রুবেল এবং জুয়েল। বাবার সর্দারির প্রতিপত্তি ধরে রাখতেই এই শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়েছেন খুনে।
রশিদপুর বাজারের কাছেই ফয়জাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুল থেকেই এবার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট, এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল আরেক আসামি পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলীর ছেলে রুবেল। এমনকি খুনের ঘটনার পরও দুটি পরীক্ষাসহ মোট ৫টি পরীক্ষা দিয়েছে। আর তার বড় ভাই আরেক আসামি জুয়েলও এই স্কুল থেকেই এসএসসি পাশ করে মিরপুরে আলিফ সোবহান চৌধুরী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত ছিলেন।
১৯৮১ সালে স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই ইংরেজির শিক্ষকতা করছেন আকবর হোসেন। তিনি বলেন, যারা পেশাদার খুনি তারা খুন করে, এটা তার অপরাধের ধরন। কিন্তু স্কুলের শিক্ষার্থীর এই অধঃপতন সমাজের জন্য কলঙ্কজনক। এমন নয় যে তারা ৪০ লাখ-৫০ লাখ টাকার জন্য খুন করেছে। হয়তো তারা যখন অপরাধটি করছিল, এর ফল কি হতে পারে তাদের ধারণা ছিলনা। তাদের বাবা'র দাপটে তারাও অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে।
আব্দুল কাদের বাংলা এবং বিজ্ঞান পড়ান এই স্কুলে। তিনি বলেন, সমাজের বিচারহীনতার যে অবস্থা তার জন্যই এ অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থী আজ খুনি হয়ে উঠেছে।
শিক্ষকরা বলেন, গত কয়েক মাস আগে রুবেল স্কুলের এক ছাত্রীকে ইভটিজিং করে। আমরা এর বিচার করতে চেয়েও পারিনি। সে তাদের পঞ্চায়েতের লোক এনে মানববন্ধন করে। স্কুলে ভাঙচুর চালায়। তার বাবা ছেলেকে শাসন না করে প্রশ্রয় দেন। উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক চেয়ারম্যানরা এলেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি রুবেলের বিরুদ্ধে।
শিক্ষকরাও ভেবেছিলেন কিছুদিন পর ছাত্রটি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। এখনকার মতো বিষয়টি থামিয়ে দেয়াই ভালো।
কাদের বলেন, সে সময় যদি রুবেলের বিচার হতো, তাহলে সে বুঝতো অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না। বিচার না হওয়াতে অপরাধের প্রতি তার ঝোঁক বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, আজও স্থানীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে- মহিউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করার। এখন যদি এখানে অপরাধী পার পেয়ে যায়, সে পরেও অপরাধ করবে এখনকার সাহস দিয়ে।
আকবর বলেন, আমি আজও নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বলেছি, যারা অপরাধ করে তাদের পরিণতি কি হয় দেখো। স্কুল শুধু শিক্ষার্থীদের বই পড়ার জায়গা নয়, আচার কানুন শেখারও জায়গা। কিন্তু স্কুলে তারা থাকে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। বাকি সময়টুকু পরিবারের সঙ্গে থাকে। সেখানে সে কি পরিবেশ পাচ্ছে এটাও বড় বিষয়।
তিনি বলেন, আব্দুল আলিম তার সন্তানদের নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার করতেন। অথচ পরিবার থেকে এ শিক্ষা দেয়ার কথা নয়। বাবার মতো তারাও রশিদপুর বাজারে প্রভাব খাটিয়ে চলতো।
১৯৮১ সালে শিক্ষকতায় যোগ দেয়া আব্দুল কাদের বলেন, এই স্কুলে এখন ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। দু’জন শিক্ষক অন্য স্কুলে ডিউটিতে রয়েছে। ৭ টি ক্লাসরুমে আমরা ৬ জন শিক্ষক পাঠদান করছি। এক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের লেখতে দিয়ে অন্য ক্লাসে পড়াচ্ছি। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ২০০। এর মধ্যে নিয়মিত আসে গড়ে দেড়শ’। ১ জন শিক্ষকের পক্ষে দেড়শ’ শিক্ষার্থীকে ভাল পাঠদান সম্ভব নয়। ফলে তাদের যে নৈতিক মূল্যবোধ শেখাবো, সামাজিক আচার শেখাবো তারও কোন উপায় নেই।
আশেপাশে আর স্কুল না থাকায় সুন্দ্রাটিকি, নিজগাঁও, শাহপুর, ভাদেশ্বর মিলে আটটি গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসেন। এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ চা বাগানের শিক্ষার্থী।
ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র আচারের প্রভাব পড়ে। টিলা, চা-বাগান অঞ্চল হওয়ায় এখানে অপরাধ প্রবণতাও বেশি।
আকবর বলেন, ৪ কোমলমতি শিক্ষার্থীকে খুন করেছে এই স্কুলের ছাত্ররা। এটা আমাদের মর্মাহত করে। এই শিক্ষা তো আমরা ওদের দেইনি, বইতেও নেই। স্কুলে অভিভাবকদের বৈঠকে আসেন না কেউ। এখানে সবাই দিনমজুর ধরনের কাজ করেন। তারাই বা কিভাবে আসবেন! তাদেরকেও সচেতন করতেও তো আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা পাই না।
এছাড়াও শিক্ষার্থীরা অনেকে কাজ করে আর পরীক্ষার সময় স্কুলে আসে। দরিদ্র এসব ছেলেমেয়েকে আমরা বাধা দিতে পারি না। কাজ করলে তাদের কিছু আয় হয়, সংসারের জন্য। না হলে স্কুলে আসা পুরোটাই বন্ধ করে দেবে। তাই তারা ফুলটাইম শিক্ষার্থীও নয়, শ্রমিকও নয়। সেখানেও সঠিক নৈতিকতার পরিবেশ তারা পায় না।
আব্দুল আলি সম্পর্কে শিক্ষকরা আরো বলেন, তিনি নিজেকে সবজায়গায় মাতব্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন। এর আগেও তার কারণে বাগানের সঙ্গে এখানকার মানুষদের বড় কাইজ্জা হয়। পূর্ব ভাদেশ্বর পুকুরপাড় এবং সুন্দ্রাটিকির মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। সেখানেও আলির বিচার না হওয়াতে তার সাহস বেড়ে যায়। যার ফল এই খুনের ঘটনা।
কাদের বলেন, কিশোর বয়সের শিশুদের অবশ্যই কিছুটা শাসনের প্রয়োজন রয়েছে।
আমাদের দেশে বেত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা পশ্চিমা ধারণা। তাদের শিক্ষিতের হার আমাদের এক নয়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও পশ্চিমা নয়।
পুলিশ জানিয়েছে, হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের পঞ্চায়েত আব্দুল আলীর নির্দেশে ৪ শিশু হত্যায় তার ২ ছেলেসহ অংশ নেয় ৬ জনের একটি দল। এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে কিলিং মিশনের সদস্য তার ছেলে রুবেল মিয়া (১৭)।
পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র জানিয়েছেন, কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী অন্যরা হচ্ছেন, আব্দুল আলীর আরেক ছেলে জুয়েল মিয়া (২২), একই গ্রামের আরজু মিয়া (২০) ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক বাচ্চু মিয়া (২৫) সহ মোট ৬ জন। তারা সবাই সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাসিন্দা। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের গ্রাম পঞ্চায়েত আব্দুল আলীর সঙ্গে নিহত শিশুদের অভিভাবকদের পক্ষের পঞ্চায়েত খালেক মিয়ার দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। তার রেশ ধরেই ৪ শিশুকে হত্যা করা হয়।
নিহত শিশুরা হলো- বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র জাকারিয়া শুভ (৮), আবদাল মিয়ার ছেলে প্রথম শ্রেণির ছাত্র মনির মিয়া (৭), আব্দুল আজিজের ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তাজেল মিয়া (১০) ও সুন্দ্রাটিকি আনওয়ারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসার নুরানী প্রথম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল মিয়া (১০)। তাদের মধ্যে শুভ, মনির ও তাজেল একে অপরের চাচাতো ভাই।
১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তাদের অপহরণ করা হয়। পাঁচদিন পর বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের ইছারবিল খালের পাশে বালু মিশ্রিত মাটিচাপা অবস্থায় ওই চার শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬
এমএন/জেডএম
** ছাত্ররা বললো, ‘ম্যাডাম তাজেল তো মারা গেছে’
** ইসমাইলের হাতের লেখা বড় সুন্দর অাছিল
**পঞ্চায়েতের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বলি শিশুরা
** ওসির গাফিলতি তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি
** শান্ত সুন্দ্রাটিকিতে শোকের ছায়া